অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন "ভবিষ্যতের মানুষজন বিশ্বাস করবে না যে এমন একজন মানুষ এই ধরাধামে কখনো হাঁটাহাঁটি করেছিলেন"..
ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হয় তাঁকে। তাঁর কথা বলতে গেলেই চোখে ভেসে ওঠে খাটো ধুতি ও চাদর পরা একজন বিরলকেশ মানুষের ছবি যাকে উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন "নগ্ন ফকির"..
সেই মানুষটিই বলেছিলেন..."মানবতার প্রতি কোনদিন বিশ্বাস হারাবেন না। কারণ মানবতা একটি মহাসাগর। সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা জল নোংরা হতে পারে কিন্তু মহাসাগর কখনো নোংরা হয় না"... সারাজীবন অহিংসা এবং সত্যের পূজারী এই মানুষটি নিজের দেশের হয়ে এবং দশের হয়ে সংগ্রাম করে গিয়েছেন। যুগে যুগে এমন কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন যাদের দর্শন বদলে দেয় গোটা পৃথিবীটাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে তারা আলোর মশাল হাতে এগিয়ে আসেন পথ দেখানোর জন্য। এই মানুষটিও এসেছিলেন এই পৃথিবীতে... সমগ্র ভারতবাসী তথা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে অহিংসার পথ দেখানোর জন্য, আলোকময় সত্যের পথে নিয়ে চলবার জন্য। বিশ্ব জুড়ে এই ভদ্রলোকের জন্মদিনটি পালিত হয় "আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস" রূপে। তিনি..... জাতির জনক.. মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী....সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত "মহাত্মা গান্ধী" অথবা "বাপুজী" নামে....যে শব্দের অর্থ "পিতা"... তাঁর জন্মদিন আজ..২রা অক্টোবর।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাঁর নাম সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অবদান কোনো মহাসাগরের থেকে কম নয়। আজ, এই নিবন্ধে বরং তাঁর সঙ্গে আরেক পৃথিবী বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক বা বন্ধুত্বের কথা নিয়ে একটু আলোচনা করি। তিনি বিশ্বকবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মজার ব্যাপার হলো গান্ধীজিকে ''মহাত্মা" সম্বোধন প্রথম করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথকেও প্রথম "গুরুদেব" সম্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী।গান্ধীজী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। হয়তো অনেক সময় তাদের মতের মিল হয়নি, আদর্শগতভাবে হয়তো কোথাও বিভেদ রয়ে গিয়েছিল কিন্তু তাতে তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা অথবা বন্ধুত্ব এতটুকুও নষ্ট হয়নি। "রতনে রতন চেনে" এই প্রবাদটি যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল এই দুই কালজয়ী মহাপুরুষের পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং সখ্যে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে সুভাষচন্দ্র বসুর রবীন্দ্রনাথের প্রতি লিখিত বক্তব্য..."আপনি সম্প্রতি গান্ধীজীর অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েছেন".. এর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে--- "এই উপলক্ষে তোমাকে একটা কথা বলা আবশ্যক মনে করি। মহাত্মা গান্ধী অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত ভারতের মনকে এক যুগ থেকে আরেক যুগে নিয়ে যেতে পেরেছেন।....... মহাত্মাজীর চরিত্রের মধ্যে এই একটা প্রবল নৈতিক শক্তিকে ভক্তি যদি না করতে পারি তবে সেইটিকে বলব অন্ধতা"...
রবীন্দ্রনাথের থেকে গান্ধীজী কিছুটা ছোট ছিলেন তাই রবীন্দ্রনাথ যতখানি ভালবাসতেন বা শ্রদ্ধা করতেন গান্ধীজীকে, তিনিও ঠিক ততখানিই শ্রদ্ধা করতেন তাঁর গুরুদেবকে। নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র শিশির বসুর লেখা থেকে জানা যায় ১৯৩৮ সালে গান্ধীজী কলকাতায় এসেছেন জাতীয় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে যোগ দিতে। তিনি উঠেছিলেন নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসুর উডবার্ন পার্কের বাড়িতে। তাঁর গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো থেকে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কথাবার্তা হওয়ার পর যখন রবীন্দ্রনাথ চলে যাবেন তখন গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের জুতোজোড়া নিয়ে এসে নিজের হাতে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর গুরুদেবের পায়ে নিজেই পরিয়ে দিলেন।
১৯২০সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ গেলেন আমেদাবাদে সবরমতী আশ্রমে। সেখানে এক ভাষণে বললেন...."মহাত্মাজীর বাণী বিশ্বের সর্বত্র বিস্তৃত হইয়াছে। অতয়েব মহাত্মাকে বিশ্বকর্মা বলা যাইতে পারে"... পরে লিখেছিলেন..."মহাত্মা অনেককে বলা হয়, তার কোনো মানে নেই। কিন্তু এই মহাপুরুষকে যে মহাত্মা বলা হয়েছে তার মানে আছে।.... আমাদের শাস্ত্রে ঈশ্বরকে বলে মহাত্মা, মর্ত্যলোকে সেই দিব্য ভালোবাসা, সেই প্রেমের ঐশ্বর্য দৈবাৎ মেলে"..
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সবসময় যে গান্ধীজীর মতের মিল হয়েছে তা নয়। কখনো কখনো মতানৈক্যও ঘটেছে যেমন মহাত্মা চেয়েছিলেন দেশের মুক্তি, বিদেশী শাসনের হাত থেকে দেশবাসীর মুক্তি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মানুষের মনের মুক্তি... মানসিক উত্তরণ। গান্ধীজীর চরকা কাটা নিয়েও দ্বিমত পোষণ করতেন। কিন্তু দুজনের মিল বা ঐক্য ছাপিয়ে গিয়েছিল অমিলকে। চরকা প্রবন্ধে কবিগুরু লিখেছেন.."মহাত্মাজীর সঙ্গে কোনো বিষয়ে আমার মতের বা কার্যপ্রণালীর ভিন্নতা আমার পক্ষে অত্যন্ত অরুচিকর।...... তাঁর মহৎ চরিত্র আমার কাছে পরম বিস্ময়ের বিষয়। ভারতের ভাগ্যবিধাতা তাঁর হাত দিয়ে একটি দীপ্যমান দুর্জয় শক্তি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।".. গান্ধীজীও তাঁর "ইয়ং ইন্ডিয়া" পত্রিকায় "কবি ও চরকা" প্রবন্ধে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও তিনি পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।
১৯৩১.... ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হল। ১৯৩২এ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হল এবং ব্রিটিশ সরকার প্রচণ্ড দমন পীড়ন নীতি গ্রহণ করলো। গান্ধীজীকে বন্দী করে রাখা হলো পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে। জেলের ভিতরেই তিনি অনশণ শুরু করলেন। গর্জে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ... বললেন.."জয় হোক সেই তপস্বীর যিনি এই মুহূর্তে বসে আছেন মৃত্যুকে সামনে নিয়ে ভগবানকে অন্তরে বসিয়ে সমস্ত হৃদয়ের প্রেমকে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে। তোমরা জয়ধ্বনি করো তাঁর। বলো, তোমাকে গ্রহণ করলেম, তোমার সত্যকে স্বীকার করলেম।".... তাঁকে দেখতে স্বয়ং কবিগুরু পৌঁছে গেলেন পুনের ইয়েরওয়াড়া জেলে.... মহাত্মা যে তাঁকে দেখতে চেয়েছেন!
সেদিন সাক্ষাতের মুহূর্তে দুজনেই ছিলেন আপ্লুত। জেলের মধ্যে একটি আম গাছের নিচে একটি খাটিয়ায় শুয়েছিলেন মহাত্মা। সেখানে প্রায় ছুটে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাত্মাজী তাঁকে দুহাতে বুকের কাছে টেনে নিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বুকে মাথা রেখে বসে রইলেন কতোক্ষণ!! গান্ধীজী বললেন "কত আনন্দ হল"!!.... তাঁর অনুরোধে গুরুদেব গাইলেন "জীবন যখন শুকায়ে যায় করুনাধারায় এসো"...
এই নিবন্ধ শেষ করি রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গান্ধীর উক্তি দিয়েই। কবিগুরু মহাত্মা সম্পর্কে বলেছিলেন ...."দেশের সৌভাগ্যক্রমে দৈবাৎ যদি এমন শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয় যার প্রভাব সকলের ওপর, তবে তাঁকে তাঁর পথ ছেড়ে দিতেই হবে, তার ধারাকে বিক্ষিপ্ত করতে পারবে না।"...
আর মহাত্মা গান্ধী তাঁর জীবনীতে বলেছিলেন...."দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের অপরাজেয় মনে হলেও শেষে সব সময়ই তাদের পতন ঘটে"....
আজকের দিনেও কতো প্রাসঙ্গিক না কথাগুলো!!
তথ্য ঋণ: রবীন্দ্র রচনাবলী,
গান্ধীজীর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ,
রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রচনাংশ