বিবেকী মানুষ গান্ধীজি

মোহনদাসের বিয়ে হয়েছিল মাত্র বারো বছর বয়সে। বিলেত গিয়েছিলেন তারও বছর পাঁচ পর। বাড়িতে বউ রেখে বিলেত! ছেলে যদি ওখানে অঘটন কিছু একটা ঘটিয়ে বসে! কাজেই মা পুতলীবাঈয়ের মনে একটা দ্বিধা ছিলই যে, ছেলেকে বিলেতে পাঠাবেন কি না। কারণ? ছেলেকে যে হাড়ে হাড়ে চেনেন! তবে এও জানেন যে, তাঁর ছেলের তেমন মিথ্যে বলার বদভ্যেস নেই, প্রবঞ্চনা করারও ইচ্ছে নেই। কিন্তু মাথায় খামখেয়ালের ভুত আছে। যেমন? এই যেমন স্কুলে পড়ার সময়, কতই বা বয়স... এই ধরুন, আট-নয়...তখনই তাঁর মাথায় চেপেছিল সংস্কার ভাঙার ভুত। সেটা কেমন? বলছি।

গান্ধীজিরা কয়েক পুরুষ ধরে বৈষ্ণব। তাঁর ‘অহিংসা’ নীতি এই বৈষ্ণবীয় ভাবধারা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রেই তিনি পেয়েছিলেন। যা বলছিলাম, সংস্কার ভাঙার ভুতের কথা। তা, গন্ধীজির ছেলেবেলায় বাড়িতে আমিষ কিছু ঢুকতই না, নিছক নিরামিষ খাওয়া হত। সে-সময়ই তাঁর মনে এল আমিষ খাওয়ার কথা, মনে হল নিরামিষ খাওয়াটা নেহাতই একটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। ছেলেদের নিয়ে তৈরি হয়ে গেল দল। তাদের নিয়ে বাঁচানো-লুকোনো পয়সা দিয়ে মাংস কিনে মাঝে মাঝেই চলতে লাগল নদীর ধারে ফিস্টি।

কিন্তু যেদিন ফিস্টি হয়, সেদিন আর রাতে খিদে পায় না কিছুতেই। বাড়িতে এটা-ওটা বলে রাতের খাবার না-খাওয়ার অছিলা চলে। এই করতে করতে একদিন বিবেক উঠল প্রবল হয়ে। বংশগতির ধারায় বাপঠাকুরদার মতো গান্ধীজির বিবেক বড়ই আবেগময় ছিল। তাই, দিনের পর দিন মায়ের সঙ্গে বাবার সঙ্গে এই মিথ্যাচার তাঁর আর ভালো লাগছিল না। একদিন মায়ের কাছে নিজেই সব খুলে বলে হালকা হলেন এবং মা-বাবার কাছে ক্ষমা চাইলেন। এমন বিক্ষিপ্ত ঘটনা তাঁর সারাজীবনেই ঘটেছে।

বিলেত যাওয়ার আগে মা তাঁকে এক জৈন সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন যে, বিলেতে গিয়ে তিনি মদ, মাংস ও মেয়েমানুষ স্পর্শ করবেন না। একে বয়স মাত্র সতের, তায় আবার জায়গাটা বিলেত - রাজার ঘর। পুরোদস্তুর সাহেব হয়ে যাওয়া ভারতীয় ছেলেদের দেখে গান্ধীজির ভারি ইচ্ছে হল সাহেবীয়ানা রপ্ত করার।

ইংরেজি, ফরাসি শিখতে লাগলেন আর শিখতে লাগলেন ইংরেজের খাবার খাওয়ার কৌশল, নাচ ও গান। মা না-হয় মদ, মাংস, মেয়েমানুষ ছুঁতে বারণ করেছেন; নাচ-গান ও পার্টিতে যেতে তো আর বারণ করেননি। ফলে, একদিন নাচে অংশ নিতে গেলেন এক পার্টিতে, সেখানে গিয়েই তাঁর বিবেক জেগে উঠল, বুফেতে দেখলেন সব মাংসের পদ, গা গুলিয়ে উঠল—পার্টি থেকে প্রায় ছুটে ফিরে এলেন বাসায়। বিবেকের ঘায়ে মাথা থেকে নামিয়ে ফেললেন সাহেবীয়ানার ভুত। আবার মায়ের কাছে আর একপ্রস্থ ক্ষমা চাওয়া।

প্রবল বিবেকবোধের জন্যই তিনি বজায় রাখতে পেরেছিলেন সত্যের পথ। আফ্রিকায় ভারতীয়দের সংগঠিত করতে গিয়ে তাই তিনি তাঁর সত্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন বৃহত্তর ভারতের সঙ্কট। হাল ধরতে ছুটে এসেছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের। সেখানেও তাঁর হাতিয়ার ছিল উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া তাঁর সেই বিবেক, অহিংসা আর সত্যের পথ। আর এই পথে চলতে চলতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আপামর জাতির জনক, সকলের ‘বাপু’।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...