সতীপীঠঃ অমরনাথ শৈবতীর্থে রয়েছে অপার মাহাত্ম্যময়ী ও রহস্যময়ী এক শক্তিপীঠ

হিমালয়-বিজড়িত কাশ্মীরকে বলা হয়, ‘দেবভূমি’। পৌরাণিক কাহিনি থেকে ভক্তসাধারণের বিশ্বাস গড়ে উঠেছে যে, এই ভূমি কোথাও দেবতাদের আবাসভূমি, কোথাও বা বিচরণভূমি। এই ভূমি যুগে যুগে মুনিঋষি দেবদেবীদের মহান তপস্যাভূমি। এই ভূমি দেবভূমি হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনেও রয়েছে পুরাণকথা। সেই কথা অনুসারে, ঋষি কাশ্যপের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে কাশ্মীরের ভূমিকে দেবস্থান হিসেবে গড়ে তোলেন স্বয়ং মাতা আদ্যাশক্তি মহামায়া বা দেবী ভগবতী। ঋষি কাশ্যপের নাম অনুসারে এই ভূমির নাম হয়, ‘কাশ্যপেপুর’। তারপর কালে কালে উচ্চারণের হেরফেরে এই ‘কাশ্যপেপুর’ সাধারণের মুখে মুখে হয়ে ওঠে ‘কাশ্মীর’।

কাশ্মীর গড়ে ওঠার সেই পৌরাণিক কাহিনিতে দেবী ভগবতী বা শক্তির অবদান থেকে এটাই স্পষ্ট যে, আদ্যিকাল থেকেই কাশ্মীরে শাক্তমহিমা প্রবল। তাই জাগ্রত শক্তিপীঠ বা একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবে কাশ্মীরের উল্লেখ তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায়। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে একটি শ্লোকে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে—

‘কাশ্মীরে কণ্ঠদেশশ্চ ত্রিসন্ধ্যেশ্বর ভৈরবঃ।

মহামায়া ভগবতী গুণাতীত বরপ্রদা।।’

শ্লোকটির অর্থঃ কাশ্মীরে দেবী সতীর কণ্ঠ পতিত হয়েছিল। তার ফলে সেখানে যে পীঠ গড়ে উঠেছে, সেই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘মহামায়া’ নামে প্রসিদ্ধা; আর তাঁর ভৈরব মহাদেব ‘ত্রিসন্ধ্যেশ্বর’ নামে প্রসিদ্ধ।

অন্যান্য সতীপীঠের অবস্থান হিসেবে তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে অধিকাংশক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট স্থানের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা নেই। এখানে ‘কাশ্মীর’ নামে বিস্তৃত ভূখণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। ফলত, এই বিস্তৃত ভূখণ্ডের পৃথক পৃথক তিনটি জায়গায় ভক্তসন্ন্যাসীরা এই সতীপীঠের অবস্থান অনুভব করেছেন। সেগুলি হল—‘অমরনাথ’, ‘শারদাপীঠ’ ও ‘ক্ষীরভবানী’। পূর্ববর্তী পর্বগুলিতে আমরা ‘শারদাপীঠ’ ও ‘ক্ষীরভবানী’—এই দুই পীঠস্থান নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছি; আজ আলোচনা করবো ‘অমরনাথ’ নিয়ে।

অমরনাথ বিখ্যাত শৈবতীর্থ। তুষারলিঙ্গের জন্য এই তীর্থ জগতবিখ্যাত। বিরাট এক গুহায় এই লিঙ্গরূপে মহাদেব অবস্থান করেন। গুহার ছাদ থেকে বিন্দু বিন্দু জল পড়ে তা ক্রমান্বয়ে বরফে পরিণত হয় এবং মহাদেবের অপূর্ব সুন্দর এই লিঙ্গরূপ গড়ে ওঠে। বরফ জমতে জমতে এই লিঙ্গের উচ্চতা কোন কোন সময় আট ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ভক্তজনের বিশ্বাস যে, তিথি অনুযায়ী চন্দ্রের হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই লিঙ্গের উচ্চতাও বাড়ে-কমে। কিন্তু এই বিশ্বাসের পেছনে বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই।

যাই হোক, শুক্লপক্ষে শিবলিঙ্গ গড়ে উঠতে শুরু করে পূর্ণরূপ পায় পূর্ণিমাতে, এই পূর্ণরূপের পূজা করা হয়। কৃষ্ণপক্ষ থেকে এই লিঙ্গ আবার জলে পরিণত হতে শুরু করে।

তুষার বা বরফের শিবলিঙ্গটি গড়ে ওঠে গৌরীপটের ওপর। গৌরীপটটি আকারে বেশ বৃহৎ। সেটি প্রায় বারো ফুট দীর্ঘ, প্রস্থে তিন ফুট এবং দু’ফুট উঁচু। তুষারলিঙ্গ যেভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্টি হয়, গৌরীপটও সৃষ্টি হয়েছে সেভাবেই। এই গৌরীপট যেমন পূজিত হন, তেমনি মূল তুষারলিঙ্গের পাশে আরও দুটি ছোট ছোট তুষারলিঙ্গ তৈরি হয় প্রাকৃতিকভাবে। এদের একটিকে পার্বতীরূপে, অন্যটিকে সিদ্ধিদাতা গণেশরূপে পূজা করা হয়।

আমরা দেখেছি যে, যেখানে যেখানে সতীপীঠ রয়েছে, সেখানে সেখানেই রয়েছেন ভৈরব হিসেবে মহাদেব; কিন্তু শৈবতীর্থের অধিকাংশেই ভগবতীর অবস্থান নেই। সতীপীঠ দেবী সতীর প্রতীকী-প্রতিমানামেই প্রায় সর্বত্র বিখ্যাত। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, যেমনঃ ‘পশুপতিনাথধাম’, ‘বৈদ্যনাথধাম’ সতীতীর্থ হয়েও ভৈরব শিবের নামে সমাদৃত। ‘অমরনাথধাম’ও সেই ব্যতিক্রমের তালিকাতেই পড়ে। এটি একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ হয়েও ‘অমরনাথ’ শিবের নামে বিখ্যাততীর্থ। ভক্তজনের কারও বিশ্বাস এই তীর্থেই দেবী সতীর ‘কণ্ঠ’ পতিত হয়েছিল, কারও বিশ্বাস এখানেই পতিত হয়েছিল দেবী সতীর ‘মস্তক’। অমরনাথতীর্থের উদ্ভবের পেছনে যে পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে, তাতে এই দ্বিতীয় বিশ্বাসের ইঙ্গিত পাই। কাহিনিটি হলঃ

শিব একদা গলায় মুণ্ডমালা পরিধান করে তাঁর তপাসনে বিরাজ করছিলেন। তাই দেখে নারদের প্ররোচনায় কৌতূহলী হলেন দেবী পার্বতী। জিজ্ঞেস করলেন মহাদেবকে, এই মুণ্ডগুলি কার? প্রশ্নের উত্তরে মহাদেব জানালেন যে, মুণ্ডগুলি দেবী পার্বতীরই। তিনি যতবার নব নব অবতারে জন্ম নিয়েছেন, ততবার মৃত্যুবরণ করেছেন। আর সব জন্মেই তিনি শিবের প্রিয়া হয়েছেন। তাই শিব তাঁর প্রিয়ার পার্থিব স্মৃতি বুকে আঁকড়ে ধরতেই তাঁর বিভিন্ন জন্মের মুণ্ড আপন কণ্ঠে ধারণ করেছেন মালারূপে। শিব অমর অনাদি, কিন্তু পার্বতী তো অমর নন। তিনি দেবী সতী হিসেবে আত্মত্যাগের পর নবরূপে জন্ম নিয়ে তবেই পার্বতী হয়েছেন। শিবের মুখে এমন ব্যাখ্যা শুনে পার্বতী একদিকে যেমন আনন্দিত হলেন, অন্যদিকে তেমনি বিমর্ষও হলেন। আনন্দিত হলেন তিনি শিবের কতটা জুড়ে আছেন জেনে, বিমর্ষ হলেন তিনি শিবের মতো অমর নন বলে। এবার শিবের কাছে তিনি আবদার করলেন, তাঁকেও অমর করে দেওয়ার জন্য। প্রিয়ার এই আবদারে শিব খুশি হলেন। এমন এক স্থানে তিনি পার্বতীকে নিয়ে গিয়ে অমরত্বের উপদেশ দিতে চাইলেন, যেখানে অন্য কেউ সেই উপদেশ শুনে অহেতুক অমর হয়ে যেতে পারবে না।

ফলত, শিব পার্বতীকে নিয়ে এলেন দেবভূমি কাশ্মীরে নির্জন হিমালয়ের এক প্রান্তে। সেখানে ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে ত্রিশূলের ছোঁয়ায় একটি বিরাট গুহার সৃষ্টি করলেন। সেই নির্জন গুহার ভেতরে শিব যোগাসনে বসে অমরত্বের উপদেশ দেওয়ার জন্য সমাধিতে লীন হলেন। সেই অবস্থাতেই বলে যেতে লাগলেন উপদেশের কথা। কিন্তু একাকী সচেতন হয়েও পার্বতী সেই উপদেশ একমনে শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। অন্যদিকে একটি পায়রা আশ্রয়ের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সেই গুহায় এসে হাজির হল। সে শিবের সমস্ত উপদেশ শুনল। এবং অমর হয়ে গেল। কিন্তু পার্বতী ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি অমর হতে পারলেন না। কিন্তু এই যে অমরত্বদানের জন্য শিবের গুহায় অবতরণ, এ ঘটনা ভক্তজনের কাছে স্মরণীয় হয়ে রইল। সেই স্মরণিকা বেয়েই কালে কালে ভক্তজনের কাছে তিনি ‘অমরনাথ’ হয়ে উঠলেন। গুহা হল তাঁর এই অমরত্বদায়ী পীঠস্থান। অমরত্ব তো মোক্ষেরই একটি স্তর। তাই অমরনাথধাম হয়ে উঠল হিন্দুদের কাছে মোক্ষতীর্থ।

এবার উক্ত কাহিনির পরতগুলি খেয়াল করুন, সেই পরতের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এই তীর্থ সতীপীঠ বা সতীতীর্থ হিসেবে গণ্য করার কারণঃ

ক. সতীপীঠে শিব ও পার্বতী দু’জনেরই উপস্থিতি থাকে। কাহিনি অনুযায়ী আমরা দেখতে পাচ্ছি, অমরনাথের গুহায় দু’জনেই একত্রে অবতরণ করে অবস্থান করছেন। এখানে দেবী শক্তি শিবের সঙ্গে পার্থিবরূপে গৌরীপট হিসেবে যেমন আছেন, তেমনি আছেন লিঙ্গরূপেও। অবস্থানের দিক থেকে তাঁর গুরুত্ব শিবের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়।

খ. কাহিনি অনুযায়ী এই স্থানেই মুণ্ড-সংক্রান্ত প্রশ্নের মাধ্যমে অমরত্বের খোঁজে দু’জনে উপস্থিত হলেন। এলেন এটাই বোঝাতে যে, সতী মৃত হয়েও মৃত নন, তিনি শিবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত; তাই তো ভৈরবরূপে মুক্ত শিব সর্বত্র তাঁর সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছেন। ফলে সতী কায়ারূপে মরেও অমর। তাঁর সেই কায়ারূপ থেকেই গড়ে উঠেছে শাশ্বত শক্তিপীঠ। তিনি নশ্বর হলে এটা সম্ভব হত না। এবার এই স্থানেই অবিনশ্বর বা অমর সতীঅঙ্গ মুণ্ডের পতন হয়েছিল বলে আমরা যদি ধরে নিই, তাহলে এই স্থানই অমরত্বদানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবী রাখে। মুণ্ডসংক্রান্ত প্রশ্নের সূত্র ধরে এখানে এসে এটাই বুঝি ইঙ্গিত দেওয়া হল, এখানেই দেবী সতীর মুণ্ড পতিত হয়েছিল।

গ. অমরত্বের উপদেশ শুনতে শুনতে দেবী পার্বতী ঘুমিয়ে পড়লেন কেন? যার অমর হয়ে ওঠার এত ব্যাগ্রতা, এত ব্যাকুলতা, এত কাণ্ড করে যিনি নির্জন স্থানে এলেন উপদেশ শুনতেই; সেখানে এসে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন কী করে! আসলে, এই ‘ঘুমিয়ে পড়া’ প্রতীকী অর্থেই গ্রহণ করা উচিত। আমাদের অনুমান, এই ঘুমিয়ে পড়ার প্রসঙ্গের মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে যে, দেবী সতীর গুপ্ত পীঠ এখানে সুপ্তভাবে রয়েছে; তাকে জাগিয়ে উদ্ধার করতে হবে, পূজা করতে হবে, তীর্থ করে তুলতে হবে। কালে কালে দেখা যাচ্ছে, পুরাণের এই ইঙ্গিত ভক্তজনের একাংশ বুঝে নিয়ে এই পীঠকে সতীপীঠ হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন।

পরিশেষে বলা যায়, সামগ্রিক বিচারে অমরনাথ সত্যিই সতীপীঠ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা নিয়ে আপামর ভক্তজনের মধ্যে সিদ্ধান্তে মিল নাও থাকতে পারে। কিন্তু ভক্তের দৃষ্টিতে কেউই অস্বীকার করেন না যে, কয়েক হাজার বছর ধরে আজও সাধক-সন্ন্যাসীরা এই তীর্থে এসে শিব-শক্তি দুজনেরই কৃপা লাভ করেন; পান মোক্ষপথের সন্ধান...          

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...