আগের দিনে মনে করে দিয়ে রাখা অ্যালার্ম-এ ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠছে তিলোত্তমা। আজকের দিনেই বোধহয় ব্যস্ততম জীবনের হারিয়ে যাওয়া ভোর ফিরে ফিরে আসে মহানগরের নাগরিক জীবনে, বহুদিন না শোনা পাখির কিচিরমিচির আর আধো ঘুম চোখে স্মার্টফোন অভ্যস্ত বর্তমান সমাজ এদিনই ঝেড়ে মুছে চালু করে পুরোনো রেডিও, আর তাতে গমগম করে বেজে ওঠে.....
'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জি, ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজেউঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধূলির সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন, আজ চিচ্ছক্তি রূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রী বিরন্ডিতা প্রতিমা, মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা …..'
এ কোনো স্তুতি, নাকি অপরিমেয় ভক্তি-নাদ, নাকি নিছকই ভালোলাগা, তা বোধহয় এখনও ঠাওর করে উঠতে পারেননা আপামর বাঙালি জাতি। শুধু তাই নয়, জাতপাত-শ্রেনী বৈষম্য-আমরা-ওরা অদূরে রেখে বছর বছর ধরে বাঙালীর মহোত্সব দুর্গাপুজোর শুভারম্ভ হয়ে যায় 'মহালয়া' থেকেই। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ কথাটা হলফ করে বলাই যায়, মহালয়া ও দুর্গাপুজার আক্ষরিক অর্থই হয়ে উঠেছে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অনতিমন্দ্র উচ্চারণে 'মহিষাসুরমর্দিনী', সুপ্রীতি ঘোষের আগমনি-গাথা 'বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতল যে ভুবন…আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন' , দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের করুনাঘন 'জাগো দুর্গা…জাগো দশপ্রহরণধারিনী…অভয় শক্তি বলপ্রদায়ীনি তুমি জাগো', মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বন্দনা 'তব অচিন্ত রুপ চরিত মহিমা, নব শোভা নব ধ্যান রুপায়িত প্রতিমা…বিকশিল জ্যোতি প্রীতি মঙ্গলা বরণে'।
সাল নিয়ে একটা মতানৈক্য থাকলেও তথ্য অনুযায়ী ১৯৩২সালে দুর্গাপুজার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রচারিত হয় দেবীমাহাত্ম্য বিষয়ক এক সঙ্গীত আলেখ্য। 'মহিষাসুরমর্দিনী' প্রথম প্রচারিত হওয়ার পরই অবিভক্ত বাংলায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। তবে তার আগের বছর ১৯৩১ সালে, বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) 'শ্রীশ্রী চণ্ডী'-র বিষয়বস্তু নিয়ে 'বসন্তেশ্বরী' নামক একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সে বছরই চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর সময়ে 'বসন্তেশ্বরী' প্রচারিত হয়। তাতে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী। তাতে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাণীকুমারও। আর সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এমনই এক সময় সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে এমন একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সেই শুরু। ১৯৩২ সালে প্রথম প্রচারিত হয় 'মহিষাসুরমর্দিনী'। বাণীকুমার এই রচনায় সহায়তা পেয়েছিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর। কয়েকটি গানে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল। তবে বেশির ভাগ গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বাণীকুমার-এর লেখণীতে 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামে বেতার সংগীতালেখ্যটি রেকর্ড করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আজও মহালয়ার দিন ভোর ৪টেয় আকাশবাণী থেকে সেই ভাষ্য এবং শ্লোক সম্প্রচারিত হয়। দীর্ঘ বছর পেরিয়েও তাতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।
শোনা যায় অনুষ্ঠানের আগের দিন রাত্রে স্টুডিওতেই থাকতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অন্য শিল্পীদের রাত দু'টো নাগাদ স্টুডিওয় নিয়ে আসা হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ স্টুডিওতেই স্নান সেরে গরদের ধুতি ও চাদর পরতেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠত। শুরু হত 'লাইভ প্রোগ্রাম'। শুরুতে রেকর্ডিং-এর সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা না থাকায়, মহালয়ার ভোরে সব শিল্পীদের নিয়ে আকাশবাণীর গারস্টিন প্লেসের পুরাতন স্টুডিও থেকে এটি সরাসরি সম্প্রচারিত হত। রাশভারি বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে সকল শিল্পীরাই সমীহ করে চলতেন। তাঁর নির্দেশেই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, শিপ্রা বসু, মানবেন্দ্র মুখোপাধায় প্রমুখ শিল্পীরা রাত ৩টের মধ্যেই স্টুডিওতে এসে হাজির হয়ে যেতেন। প্রথম দিকে কয়েক বছর রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজকুমার মল্লিক যুগ্ম সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন। তবে পরবর্তী কালে এই অনুষ্ঠানে এসেছিল বেশ কিছু পরিবর্তন। বদলেছিল শিল্পীর তালিকাও। শুধু বদলায়নি গ্রন্থণা ও শ্লোক আবৃত্তির সেই শিল্পী।
সত্তরের দশকে আকাশবাণী হঠাত্ ঠিক করে আর পুরনো 'মহিষাসুরমর্দিনী' নয় নতুন রেকর্ডিং চাই, কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বদলে কে আসবেন???? ঠিক হলো সেই কাজ করবেন উত্তম কুমার। উত্তম কুমার তখন বাঙালী সমাজের হার্টথ্রব। উত্তম কুমার ফ্লপ করবেন না এইটুকু নিশ্চিত। সঙ্গে নিয়ে আসা হলো তাবড় তাবড় মিউজিশিয়ানদের, যাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলেন লতা মঙ্গেস্কর। রেকর্ডিং তো হলো কিন্তু বাঙালী তা গ্রহণ করলনা। তাতে গ্ল্যামার ছিল কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন না উত্তম। অনুষ্ঠান হলো ফ্লপ। বেতার কর্তৃপক্ষ একেবারে গোপনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে কিছু না জানিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করায় তিনি কষ্ট পেয়ে শুধু একটাই কথা বলেছিলেন, 'ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?'। ভুল শুধরে নিয়ে উত্তম কুমার নিজে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আসেন তাঁর কাছে, আর এই ঘটনার পর আকাশবাণী ঠিক করে নতুন রেকর্ডিং আর নয়…. আবারো ফিরে এল রেডিওতে ব্যরিটোন আওয়াজ…
'সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তি প্রদায়িনী।
ত্বং স্তুতি স্তুতয়ে কা বা ভবন্তি পরমোক্তয়।
সর্বস্য বুদ্ধিরূপেন জনস্য হৃদি সংস্থিতে,
স্বর্গাপবর্গদে দেবী নারায়নী নমোহস্তুতে।
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।।'
দেবী প্রসন্ন হলেন।
মহালয়ার দিনে শুভ সূচনা হল শুভ মহরত্-এর।