“ ভীম জীবিত?”
ভীমের মাটির মূর্তি ভেঙে ফেলার পর এটাই ছিল ধৃতরাষ্ট্রের প্রথম প্রশ্ন।
ভীম উত্তর দিয়েছিল, “আমি আপনার আশীর্বাদের জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি যদি এখনও আমার ওপর রেগে থাকেন তাহলে দুঃখিত।”
ধৃতরাষ্ট্র চোখের জল মুছে, তিনি বললেন “আমি কি তোমার বুকে লেগে থাকা রক্তটা মুছে দিতে পারি?”
বি আর চোপড়ার মহাভারতের এই দৃশ্য কেঁদে ছিল গোটা দেশ। দৃশ্যের শেষে আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েন ধৃতরাষ্ট্র আর ভীম।
দেশবাসীর হৃদয় জয় করে নেন ভীমের অভিনেতা প্রভীন কুমার সবতি। আজও ‘ভীম’ বললে ভারতবাসী তাঁকেই বোঝে।
শক্তপোক্ত তাগড়াই চেহারা। অভিনয়। কমেডি সেন্স, মিঠে-কড়া সংলাপ দিয়ে নজর কেড়েছিলেন শুরু থেকেই। দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই যে শুধুমাত্র ‘শখ’-এর বশে পা রেখেছেন অভিনয় জগতে। দর্শকরা তাঁকে পুরোদস্তুর ‘অভিনেতা’ হিসেবেই মনে রেখেছিল।
অথচ প্রভীন ‘ভীম’ হয়ে ওঠার আগে থেকেই তারকা। অ্যাথলিট দুনিয়া তাঁকে তাঁর নাম দিয়েই একডাকে চিনত। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত রাজ করেছেন ক্রীড়া জগতে। হ্যামার আর ডিস্কাস থ্রো-তে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধি। সোনা রুপো দুই-ই এনেছেন দেশের জন্য।
১৯৬৬ এবং ১৯৭০-এ হংকং এশিয়ান গেমসে। ১৯৬৬’র ওই একই বছরেই কিংসটনে কমনওয়েলথ গেমসে রুপো জেতেন। ১৯৭৪-এ তেহরানে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস থেকেও রুপো জিতে আসেন। দু’দুবার অলিম্পিকের আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
আন্তর্জাতিক আসরে হিংসে করার মতো তাঁর সাফল্য, কিন্তু সেই আসরে পৌঁছাবার সুযোগ মোটেই খুব সহজ ভাবে পাননি। কেরিয়ারের একেবারে সোনালী সময়ে কাবু করে ফেলে মারাত্মক ব্যাকপেইন। অনেকেই ভেবেছিল অমিম্পিকের আশা শেষ প্রভীনের। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতাকে হারিয়ে কামব্যাক করেছিলেন তিনি। ১৯৬৮-এর অলিম্পিক অডিশনের হিটে রেকর্ড করেছিলেন। অলিম্পিকে কাঙ্খিত সাফল্য আসেনি, কিন্তু শারীরিক যন্ত্রণাকে হারিয়ে মাঠে ফিরে আসা তাঁর কাছে অলিম্পিক পদক জয়ের মতোই আনন্দের ছিল।
আশির দশকে প্রভীনের সিনেমার জগতে আসা। কিছুটা অ্যাডভেঞ্চারের মতোই। খেলার দুনিয়ায় সাফল্য তো পেয়েইছিলেন, তাও কেন এলেন অভিনয়ের জগতে? এমন প্রশ্নের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে তাঁকে। তাঁর নিজের কথায়, “খেলায় আমি নামযশ সবই পেয়েছিলাম। ভালোবাসাও পেয়েছি খুব। খেলা ছাড়ার পর মনে হল জনপ্রিয়তা আমি কোনওভাবেই হারাতে পারব না। আমি লাইমলাইটে থাকতে চেয়েছিলাম। তাই সিনেমা...”
প্রথম ছবিতে প্রভীনের কোনও সংলাপ ছিল না। রবিকান্ত নেগিচের পরিচালনায় ‘ফর্জ’। একেবারে আনকোরা। খেলার দুনিয়ার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ জগতের। চেষ্টা চালাচ্ছিলেন দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার। পেরেওছিলেন। সত্যিকারের ব্রেক পান ‘রকসা’ ছবিতে।
একবার গেরিলার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই ছবিতে লিড রোলে ছিলেন জিতেন্দ্র।
‘রিস্তে মেঁ তো হাম তুমাহরে বাপ লাগতে হ্যায়...নাম হ্যায় শেহনশাহ’ ডায়লগ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে এসেছিল পাঞ্চ! অমিতাভের দিক থেকে। উল্টো দিকের অভিনেতা প্রভীন। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করেছিলেন ‘শেহনাশাহ’ ছবিতে।
পরপর আরও বেশ কিছুতে ছবিতে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিলেনের পাশে। অ্যাকশন দৃশ্যে।
জীবন বদলে যাওয়া সুযোগটি আসে আশির দশকের শেষের দিকে। তখন বি আর চোপড়া ‘মহাভারত’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মুখ খুঁজছেন। প্রভীনের এক বন্ধু ভীমের চরিত্রের জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেন বি আর চোপড়ার কাছে।
চেহারা দেখে তো চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হয়ে যান। কিন্তু ডায়লগ ডেলিভারিতে বারেবারে ফেল। শেষ পর্যন্ত প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
এক সপ্তাহ সময় চেয়েছিলেন প্রভীন। অনুরোধ করেছিলেন বি আর চোপড়াকে। বলেছিলেন ব লে ফেলবেন নিজেকে। যদি না পারেন তাহলে সরে যাবেন।
সময় পেয়েছিলেন। সেটে ফিরেও ছিলেন। বাকিটা ইতিহাস। সেই ইতিহাসের লেখক প্রভীন নিজে।
প্রভীনের নিজের কথায়, “বাড়িতে একটা মহাভারত কিনে এনেছিলাম সেদিন। প্রতিদিন সকালে উঠে জোরে জোরে পড়তাম। অনুশীলন চলত দিনভর।”
যে যে কঠিন শব্দে হোঁচট খেতেন, সেগুলো লিখে রাখতেন খাতায়। এক সপ্তাহ পর সেটে ফিরলেন। শুটিং শুরু হল। প্রভীনকে দেখে চমকে গেলেন সকলে! এ যেন একেবারে অন্য কেউ! রাতারাতি বদলে ফেলেছিলেন নিজেকে।
মহাভারতের দ্বিতীয় পান্ডব হিসেবেই মনে থেকে গিয়েছেন দর্শকদের। কোমলে-কঠোরে এমন ভীম যে বিকল্পহীন!