মুখে এতটুকু মেকআপের ছোঁয়া নেই, চোখে কাজল দূরস্ত। আরও একটু ভাল ভাবে দেখলে নজরে আসবে ঠোঁটে লিপস্টিকের টান। কিন্তু সে রংও যেন আশ্চর্য স্বাভাবিক। মনে হবে না যে তিনি পর্দার তারকা। কখনও শাড়ি, কখনও ওয়েস্টার্নে। বাড়ির ছাদ, বিছানা, ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সাদাকালো ছবি। আজকের ভাষায় ক্যান্ডিড ক্লিক। প্রতি ফ্রেমেই আশ্চর্য স্বাভাবিক। যেন এক অন্য মধুবালা!
পর্দায় যাকে দেখে দুলে ওঠে তামাম দেশের হৃদয় তিনি নন, ছবির কন্যা যেন অন্য কেউ। রূপটান ছাড়া সে ছবি দেখে এক লহমায় ইংরেজির একটা শব্দই মনে আসে, ‘এলিগেন্স’! এলিগেন্স! এবং এলিগেন্স!
সাদাকালো ফ্রেমে মধুবালার ঘরোয়া নানা মুহূর্তের একটি ফটোগ্রাফ সিরিজ দারুণ জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে। যতই বারবার দেখা হোক না কেন, যতবার চোখে পড়বে ততবারই থমকে দাঁড়াতে হবে ছবির সামনে। যখনই দেখবে তখনই নতুন।
ভারতীয় ছবির ‘দ্য ভেনাস’ বলা হত মধুবালাকে। আসল নাম মমতাজ জাহান দেহলভি। ভারতীয় ছবির সবচেয়ে প্রভাবশালী তারকা। অপার্থিব সৌন্দর্য আর অভিনয় এই দুয়ের মিশেলে মধুবালা। পর্দায় এক বিস্ফোরণ। তবে সে বিস্ফোরণ অদ্ভুত স্নিগ্ধতার।
১৯৫১-তে চিত্র সাংবাদিক জেমস বার্ক আমেরিকার বিখ্যাত ‘লাইফ’ পত্রিকার জন্য মধুবালার এই সাদাকালো ছবির সিরিজ করেছিলেন।
ছবি ভাল ভাবে লক্ষ্য করলে মধুবালার গায়ে একটাও অ্যাকসেসারিজ মানে গয়না দেখতে পাবেন না। একেবারে খালি। মধুবালা ব্যক্তিগত জীবনেও ঠিক এমনটাই ছিলেন। দামী পোশাক বা গহনার প্রতি কোনও টান ছিল না। সে ব্যাপারে অর্থ ব্যয় করতেও নারাজ ছিলেন শেষ দিন পর্যন্ত।
ফটোশুটের পর জেমস বার্কের পত্রিকা মধুবালাকে শিরোনাম দিয়েছিল ‘দ্য বিগেস্ট স্টার’। শুধুমাত্র বলিউড বা এ দেশের নিরিখে নয়, আন্তর্জাতিক তারকার মাপকাঠিতেই। তুলনা করা হইয়েছিল মেরিলিন মনরোর সঙ্গে।
সেই ছবি সিরিজের ক্যাপশন দিয়েছিলেন ডেভিড কোর্ট। ১৯৫২-র আগস্ট সংখ্যা শিল্প এবং চলচ্চিত্রের বিশেষ সংখ্যা হিসেবে করা হয়।
ডেভিড কোর্ট নির্বাচক করেন মধুবালাকে। সাড়ে তিনটে পাতা জুড়ে শুধুই সাদাকালোয় মধুবালা। ছবির তলায় লেখা, “দ্য বিগেস্ট স্টার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড- অ্যান্ড শি ইজ নট ইন বেভেরলি হিলস…”
ডেভিড লিখেছিলেন উনিশ বছরের ছোট্ট এক মেয়ে। বাঁকা ধনুকের মতো ভ্রু। লাজুক মিষ্টি হাসি, গত দু’বছর ধরে ভারতীয় ছবির জগতে এই মেয়েই শীর্ষে রাজত্ব করছে।
এই পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার ঠিক এক দশক আগে ছবির দুনিয়ায় পা রাখেন মধুবালা। বম্বে টকিজের ‘বসন্ত’ ছবিতে। মধুবালা তখন ‘বেবি মমতাজ’। অভিনয়ের সঙ্গে ছবিতে গানও গেয়েছিলেন।
এই মধুবালা সিরিজের চিত্রসাংবাদিক জেমস বার্ক ছিলেন এই বিশ্ব বিখ্যাত পত্রিকার ‘পে রোল’-এ থাকা চিত্র সাংবাদিক। ছবি আর ক্যামেরা ছাড়া আর কিচ্ছু বুঝতেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন একেবারে সামনে থেকে। যুদ্ধভূমিতে। ১৯৪৮ সাল থেকে চিত্র সাংবাদিক হিসেবে পত্রিকায় যোগ দেন। এহেন মানুষটি বলতেন, তিনি যা কিছু বলতে চান তার সবটাই বলেন ক্যামেরা দিয়ে।
মধুবালার আগে বেগম পারাকে নিয়ে সিরিজ করেছিলেন। তবে মধুবালাকে রাজি করানো বা ফটোশ্যুটের প্রস্তাব দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না তাঁর জন্য। একে মধুবালার অভিভাবকদের চাপ, অন্য দিকে মধুবালা স্বয়ং। ভীষণ ‘প্রাইভেট পার্সন’। শুটিঙের বাইরে দেখা যেত না বিশেষ। সাক্ষাতের জন্যও দেখা পাওয়া কঠিন। তবু অসম্ভবকে কার্যত সম্ভব করতে সফল হন জেমস বার্ক।
তাঁর ক্যামেরায় আবিষ্কৃত হন অন্য এক মধুবালা! চিত্র সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সেই সাফল্য আজ ঐতিহাসিক দলিল। দর্শকদের মধুবালা-দর্শন অসম্পূর্ণ তাঁকে ছাড়া।
তথ্যসূত্রঃ আউটলুক পত্রিকা