মাছ-মিষ্টি-মোর। কোনও ভিনদেশীর কাছে কলকাতা কেমন এই বর্ণনা করতে এই তিন শব্দই যথেষ্ট। বাঙালি যেখানেই যাক না কেন তাকে চেনা যায় তার মাছ খাওয়া দেখে। বাঙালির মাছপ্রীতির খ্যাতি গোটা দুনিয়া জানে। মিষ্টি ছাড়া বাঙালি হয় না। তাদের সুখে মিষ্টি, দুঃখে মিষ্টি। পড়শী রাজ্যের সঙ্গে জবরদস্ত লড়াই করে জিতে নিয়েছে রসগোল্লার অধিকার। গোটা বিশ্বকে জোর গলায় জানিয়েছে ‘রসগোল্লা আমাদের...’
এ নয় গেম মাছ আর মিষ্টির কথা, কিন্তু ‘মোর’। কলকাতার ‘মোর’ যে অনেক। সেখানে ক্রিকেট আছে, ফুটবল আছে, গান, সিনেমা, থিয়েটার, রাজনীতি, মিছিল, মিটিং আর আবেগ আছে। আবেগ ছাড়া কলকাতা হয় না। সেটাই কলকাতার প্যাশন। ভাল যাকে বাসে তার জন্য জান কবুল করতে পারে এই শহর। তাই তো কলকাতা সিটি অফ জয়!
জীবন যেমনই হোক, ফুটপাত বা বহুতল হইহই করে বাঁচতে জানে কলকাতা। এই শহর দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। মেধা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চর্চায় গোটা দেশ তো বটেই পৃথিবী কুর্নিশ জানায়। কলকাতা আসলে ‘চালাক’দের শহর!
ছয় নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই শহরের বিশিষ্ট নাগরিক। স্যার রোনাল্ড রস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাদার টেরেজা, সি ভি রমন, অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়। কলকাতা সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের শহর। একসময় গোটা দেশের সিনেমা জগৎকে পথ দেখিয়েছে কলকাতার সিনেমা ক্ষেত্র। হেমন্ত, সলিল, মান্না দে, রবিশঙ্কর থেকে আজকের অরিজিৎ সিং একের পর এক নাম!
কলকাতা ঐতিহ্যকে আগলে রাখতে জানে। সঙ্গে নতুন নতুন অভিজ্ঞতাতেও এই শহরের সমান আগ্রহ। ১৯০২ সালে এশিয়ার প্রথম ট্রাম চালু হয়েছিল এই শহরে। ১৫০ বছরে পা দিয়েও আজও শহরের পথে ট্রাম নিত্য পথের যাত্রী। এখন ট্রামের কামরা বাতানুকূল।
১৯৮৪ সালে দেশের মধ্যে প্রথম মেট্রোরেলও শুরু হয় এই শহরেই। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য শহরেও চালু হয়েছে মেট্রো, কিন্তু কলকাতা মেট্রোর মহিমাই আলাদা। কলকাতায় বেড়াতে এলে কালীঘাট কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে মেট্রো সফরে ফেরা পর্যটকদের আজও আকর্ষণ করে। হাওড়া স্টেশন দেশের সবচেয়ে পুরনো আর বড়ো রেলওয়ে স্টেশন। ২৩ টি প্লাটফর্ম আছে এখানে ৬১৭র বেশি প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্রতিদিন যাতায়াত করে। যাত্রীদের শোরগোল, কুলির হাঁকডাক, রেলের বাঁশি সব মিলিয়ে দেশের ব্যস্ততম রেলস্টেশনের তকমা পাওয়া হাওড়া স্টেশন যেন জ্যান্ত সিনেমা। রাতের বেলা আলোকমালায় সেজে ওঠা হাওড়াস্টেশন দেখলে মনে হবে এই আসলে রাতের রানী। আপনি চাইলে থাকতেও পারেন এই চত্বরে। তার জন্য আছে ওয়েটিং রুম বা যাত্রীনিবাস।
হাওড়া স্টেশন থেকে বেরলেই হাওড়া ব্রিজ ওরফে রবীন্দ্র সেতু। হাওড়া আর কলকাতার যোগ সূত্র। এই সেতু কলকাতার মাথার মুকুট। দেশের সবচেয়ে পুরনো। ইংরেজদের তৈরি।
দেশের মধ্যে প্রথম মোবাইল শুরু হয়েছিল কলকাতায়। ১৯৯৫ সালে ৩১ জুলাই কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে দিল্লির সঞ্চার ভবনে প্রথম কলটি গিয়েছিল। ফোনের একপ্রান্তে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু অপর প্রান্তে কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী সুখরাম।
দেশের সবচেয়ে পুরনো চিড়িয়াখানাও এই কলকাতাতেই। আলিপুর পশুউদ্যান। বিষবের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল মাঠও এই কলকাতাতেই। সল্টলেক স্টেডিয়াম। কলকাতার হৃদয়ের একদিকে ক্রিকেট আর একদিকে ফুটবল। ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ক্রিকেট আর দেশপ্রেমের টানে ফুটবল। খালি পায়ে ইংরেজ বুটের সঙ্গে লড়াই করে জয় ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার ছেলেরা, সেই ইতিহাস কী বাঙালি ভুলতে পারে! কখনও ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান। কখনও ব্রাজিল আর্জেন্টিনা। কলকাতা যে ফুটবলের রাজধানী। ফুটবল বিশ্বকাপের সময় রং বদলে যায় এই শহরের। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বিশ্বকাপটা বুঝি এই শহরেই হচ্ছে, ভারত খেলুক বা না খেলুক অলি-গলি-রাজপথ রঙিন হয়ে ওঠে প্রিয় দু’দেশের পতাকার রঙে।
ইডেন গার্ডেন দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম স্টেডিয়াম। প্রতিটি ক্রিকেটারের জীবনে স্বপ্ন থাকে একবার না একবার ইডেনের বাইশ গজে খেলা। সে ছক্কাই হোক বা বলের জোরে উইকেট ছিটকে দেওয়া মনে রাখবেই শহরের দর্শক। ইডেনের সম্পদ কলকাতার ক্রিকেটপ্রেমীরা। তাদের প্যাশন আর ক্রিকেট ঘিরে উন্মাদনা। কখনও শচীন, কখনও দাদার কখন ও আবার ক্রিস গিল বা স্টিভ ওয়ার!
ইংল্যান্ডের পর দুনিয়ার সবচেয়ে পুরনো পোলো ক্লাব গড়ে উঠেছিল কলকাতায়।.১৮৫৮ সালে ব্রিটিশরা স্থাপন করেছিল কলকাতায়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে তখনও এ নজির নেই। নাম রয়্যাল পোলো ক্লাব। বহু আন্তর্জাতিক ম্যাচ, টুর্নামেন্ট হয় এই ক্লাবে।
কলকাতা পড়তে ভালোবাসে। বই কলকাতার প্রাণ। পড়ুয়া মানুষ এই শহরে আলাদা কদর পায়। তাই দেশের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার কলকাতাতেই যে গড়ে উঠবে এতে আশ্চর্যেরকী আছে! আলিপুরের জাতীয় গ্রন্থাগার।
বাঙালির বইপাড়া মানে কলেজ স্ট্রিট এশিয়ার বৃহত্তম বই বাজার। মধ্য কলকাতায় ৯০০ মিটার লম্বা এই অঞ্চল পৃথিবীর বৃহত্তম সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের মার্কেট। প্রায় প্রতিটি ভারতীয় এবং বহু বিদেশি ভাষার বই পাওয়া যায় এখানে।
বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, পুরো নাম এম পি বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম এশিয়ার বৃহত্তম তারামন্ডল। প্রতিদিন হাজারের বেশি দর্শক আসে এখানে। সাঁচি স্তুপের আদলে তৈরী। ১৯৬৩ সালের ২ জুলাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই প্ল্যানেটরিয়ামটি উদ্বোধন করেছিলেন। এমএল ডালমিয়া অ্যান্ড কোম্পানি এই প্ল্যানেটরিয়ামটি নির্মাণ করেছিল। এই সংস্থার প্রধান ছিলেন বিসিসিআই-এর প্রাক্তন সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া।
কলকাতা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগর। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২২ হাজার মানুষের বাস। ইংরেজ আমলে লন্ডনের পরেই ছিল কলকাতার গুরুত্ব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী। এই শহরকে ব্রিটিশরা বলত ‘সিটি অফ প্যালেস’। হোটেল গ্রেট ইস্টার্ন ছিল ‘জুয়েল অফ ইস্ট’। একসময় কলকাতা-লন্ডনের মধ্যে বাসও চলত। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের প্রথম গভর্ন জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণের পর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে কলকাতা। তখন অবশ্য নাম ‘ক্যালকাটা’। ২০০১ সালে সর্বত্র সরকারিভাবে নাম বদলে হয় ‘কলকাতা’।
শেক্সপিয়র বলেছিলেন নামে কী এসে যায়। এ শহরের ক্ষেত্রে যেন তাঁর এই কথাটাই খাটে। সরকারি খাতায় যতই ‘ক্যালকাটা’ থেকে ‘কলকাতা’ হোক এই শহর। বদলায় না মানুষের হৃদয়। কলকাতা ভালোবাসার শহর। প্রেমের শহর। পর কে আপন করতে এই শহরের আজও জুড়ি নেই। চায়ের দোকান থেকে পাড়ার রক সিনেমা হোক বা রাজনীতি তিন বাঙালি এক হল তো আড্ডা জমবেই! আড্ডা ছাড়া বাঙালি ভাবাই যায় না। সেই আড্ডা কখনও উঠে আসে সংসদ ভবনের অন্দরে, কখনও বা বইয়ের পাতায়। মেধায়-মননে আজও বিবিধের মাঝে সেরা কলকাতা আর বাঙালি দুই-ই!