সতীপীঠঃ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেই রয়েছেন আদ্যাশক্তি মা বিমলা

পুরী বা পুরুষোত্তমক্ষেত্র অনেক অপার্থিব লীলার এক পার্থিব স্থান। শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব প্রভৃতি পঞ্চোপাসক হিন্দুভক্তের এক এবং অদ্বিতীয় মোক্ষতীর্থ। কেননা, বৈষ্ণবের কাছে পুরীর মুখ্যমন্দিরে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ স্বয়ং বিষ্ণু, শৈবদের কাছে জগন্নাথ আসলে শিবেরই রূপান্তর; আর শাক্তদের কাছে জগন্নাথ হলেন দেবী আদ্যাশক্তি বিমলার ভৈরব। জগন্নাথ মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যেই দেবী সতীর একান্নপীঠের অন্তর্গত দশতম পীঠটি রয়েছে। এখানে দেবী সতীর নাভি পতিত হয়েছিল। ‘পীঠনির্ণয় তন্ত্র’ গ্রন্থে তাই বলা হয়েছেঃ

‘উৎকলে নাভিদেশশ্চ বিরজাক্ষেত্রমুচ্চতে

বিমলা সা মহাদেবী, জগন্নাথস্তু ভৈরবঃ।।’

কিংবদন্তি অনুসারে, আজ আমরা জগন্নাথ মন্দিরের যে চৌহদ্দি দেখতে পাই, অতি প্রাচীনকালে সেই বিস্তৃত অংশজুড়েই ছিল দেবী বিমলার পীঠ। শবর বিশ্বাবসুর অরণ্যগুহা থেকে নীলমাধবের ইচ্ছে হয়েছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নগরে এসে অধিষ্ঠিত হওয়ার। রাজা এবং প্রজাসাধারণের পূজা পাওয়ার ইচ্ছে জেগেছিল তাঁর মনে। সেই ইচ্ছে পূরণ করবার ভার পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন কৃতার্থ হন। বিদ্যাপতি নামের এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে অনুসন্ধান করিয়ে নীলমাধবকে হরণ করেন। তারপর নীলমাধবেরই ইচ্ছায় দারুমূর্তিতে তাঁর নবরূপ গড়েন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। সেই দারুমূর্তির নাম হয় ‘জগন্নাথ’।

640px-Minor_temples_in_Jagannath_Puri

জগন্নাথ নগরের যে অংশে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে তাঁকে অধিষ্ঠিত করতে গিয়ে রাজা পড়লেন খুব মুশকিলে। তিনি জানতে পারলেন যে, স্থানটি আসলে এক সিদ্ধ সতীপীঠ। পৌরাণিককালে দেবী সতীর নাভিমণ্ডল ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনের ঘাতে কর্তিত হয়ে পতিত হয়েছিল এখানে। তারপর সেই নাভিমণ্ডল রূপান্তরিত হয়েছে শিলায়। কিন্তু দেবী পূজিতা হন মূর্তিতে। দেবীর নাম, ‘বিমলা’। দেবীর গায়ের রঙ জোছনার মতো সাদা। সাদা ফুলের মালা, উজ্জ্বল সাদা বস্ত্রে তিনি সুসজ্জিতা। তাঁর চারটি হাত। ডানদিকের দুই হাতে অক্ষমালা ও অমৃতকুম্ভ; বামদিকের দুই হাতে সর্প ও বরাভয়। দেবী পূর্বমুখে বসে রয়েছেন শবাসনে। মূর্তির উচ্চতা চার ফুটের মতো। দেবী পূজিতা হন তন্ত্রমতে। তাঁর এই পীঠে তাই তান্ত্রিকদের নিত্য আনাগোনা চলে। চলে নিত্য সাধনা।

দেবীপীঠের এই স্বরূপ দেখে রাজা প্রথমটায় বেশ দুর্ভাবনায় পড়লেন। জগন্নাথকে এখানে অধিষ্ঠিত করবেন কীভাবে! দেবতার ইচ্ছে পূরণ করবেন কীভাবে! তারপর ভাবলেন, নিশ্চয় এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। নইলে, জগন্নাথ কী জানেন না যে, এখানে দেবীর সিদ্ধপীঠ রয়েছে! রয়েছে পাষাণ-মন্দির! তবুও যখন ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, তখন নিশ্চিত চেষ্টা করলেই উপায় হবে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সেখানেই বসে পড়লেন দেবীর ধ্যানে। তাঁর সাত্ত্বিক মন ও নিবিষ্ট ধ্যানে দেবী তুষ্ট হলেন। দর্শন দিলেন রাজাকে। বললেন, বল বৎস, কী তোমার অভিলাষ!

রাজা দেবীকে প্রণতি জানিয়ে স্তুতিতে বন্দনা করে জানালেন জগন্নাথের অভিলাষ। সব শুনে মুচকি হেসে দেবী বললেন, স্বয়ং জগতের নাথ জগন্নাথ এখানে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তার চেয়ে আহ্লাদের কথা আর কী হতে পারে! তাঁর আকাঙ্ক্ষা আমার কাছে আশীর্বাদ। আমি আমার পীঠমন্দির নিয়ে একপাশে সরে যাব, তুমি ধুমধাম করে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করো এখানে। কিন্তু তার জন্য আমার একটি শর্ত আছে!

রাজা দেবীর পূর্বকথায় বেশ আহ্লাদিত হয়েছিলেন। এবার শর্তের কথায় বেশ শঙ্কিত হলেন। কী জানি কোন কঠিন শর্ত দেবী তাঁর কাছে রাখেন! সেই শর্ত যদি পূরণ না-করতে পারেন, তবে তো জগন্নাথকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না এখানে! এসব ভেবেই ভয়ে ভয়ে তিনি বললেন, কী শর্ত মাতা?

দেবী হেসে বললেন, ভয় নেই বাছা, শর্ত তেমন কঠিন কিছু নয়; তবে তাতে দায়িত্ব আছে। আমার যে নিত্যপুজো হবে তাতে ভোগ হিসেবে যেন জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট নিবেদিত হয়, তার অন্যথা যেন না-হয়, দেখো!

দেবীর এমন প্রার্থনা শুনে রাজা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। গদগদ হয়ে দেবীর চরণে প্রণিপাত করে বললেন, তাই হবে মা, তাই হবে! যতদিন চন্দ্র-সূর্য রয়েছেন, ততদিন তার অন্যথা হবে না মা, অন্যথা হবে না...!

রাজাকে এইভাবে কৃপা করে দেবী অদৃশ্য হলেন। তারপরই ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। পীঠপ্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে যে পবিত্র ‘রোহিণী কুণ্ড’ নামের জলাশয় রয়েছে, ঠিক তার পশ্চিম তীরে পীঠসহ সরে গেল দেবীর মন্দির। তখন দেবী ছেড়ে যাওয়া স্থানেই রাজা শুরু করলেন সুবিশাল মন্দির নির্মাণ। তারপর সেই মন্দিরে একদিন প্রতিষ্ঠা করলেন ভাইবোনসহ জগন্নাথদেবকে।

যাই হোক, দেবী বিমলার মন্দিরটি দেখলেই বোঝা যায় যে, এটি জগন্নাথদেবের মন্দিরের চেয়েও প্রাচীন। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দিরের সংস্কার করে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ২০০৫ সালে। মন্দির-পরিকল্পনায় প্রথা মেনেই অন্দরে মনোরম চারটি অংশ রয়েছে, যথাঃ বিমান বা গর্ভগৃহ, জগমোহন বা সভাকক্ষ, নাট মন্দির বা উৎসবে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ এবং ভোগ মণ্ডপ বা ভোগ নিবেদনের জন্য নির্মিত কক্ষ। ভোগ মণ্ডপে দেবীরই ইচ্ছানুসারে জগন্নাথকে নিবেদিত প্রসাদ নিবেদন করার প্রথা আজও বহমান রয়েছে। জগন্নাথের প্রসাদ তাঁকে নিবেদন করা হলে, তারপর তা ‘মহাপ্রসাদ’ হয়। এই মহাপ্রসাদ পেয়ে ভক্তেরা ধন্য হন। এছাড়াও আলাদা করে দেবীকে ক্ষীর ও দই নিবেদন করা হয়। এই দুটি নৈবেদ্য দেবীর পরমপ্রিয়। ভক্তদের বিশ্বাস, আরাধনায় তুষ্ট করতে পারলে দেবী ভক্তকে সম্পদ দান করেন, আয়ু বৃদ্ধি করেন।

দেবীর মন্দিরে শারদীয়া উৎসব খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। পূজা ও উৎসব চলে ষোল দিন ধরে। দেবী সারাবছর জগন্নাথের শুধু উচ্ছিষ্ট এবং নিরামিষ ভোগ খেলেও এই সময় তার পাশাপাশি আমিষ ভোগও খেয়ে থাকেন। সেই জন্য এই সময় দেবীর উদ্দেশ্যে ছাগবলিও হয়ে থাকে। জগন্নাথ যেহেতু বৈষ্ণবের পরম উপাস্য, তাঁর পুজোয় রক্তপাত বিধানবিরুদ্ধ, জগন্নাথ রক্তপাত দেখতেও চান না; তাই জগন্নাথের নিদ্রাভঙ্গের পূর্বেই ভোর রাতে পাঁঠাবলি দিয়ে দেবীকে নিবেদন করা হয়।

দেবী বিমলা বছরের বিভিন্ন সময় জগন্নাথের স্নানযাত্রা, জলকেলিতে ছলনমূর্তিতে তাঁর সঙ্গী হন। কেননা, জগন্নাথ হলেন তাঁর পীঠসঙ্গী, তাঁর রক্ষক, তাঁর ভৈরব।

এখানেই একটা প্রশ্ন ওঠে যে, অন্যান্য সতীপীঠে আমরা শক্তির ভৈরব হিসেবে শিবকে দেখি, কিন্তু এখানে জগন্নাথকে দেখছি কেন? আমরা জানি যে, জগন্নাথ বিষ্ণুর অবতার। আমরা এও জানি যে, শক্তির ভৈরব শিব ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। তাহলে এখানে জগন্নাথ কেন? আর দেবী হঠাৎ করে জগন্নাথের উচ্ছিষ্টভোগ নৈবেদ্য হিসেবেই বা চাইলেন কেন? দেবী উচ্ছিষ্ট খাবেন, এটা আমরা কোন পীঠেই দেখি না, তাহলে এখানে দেখছি কেন?

দুটো প্রশ্নেরই উত্তর আছে একটা কিংবদন্তিমূলক গল্পে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, একবার বৈকুণ্ঠে ভগবান বিষ্ণুকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন স্বয়ং শিব। সেই সময় বিষ্ণু আহার গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু শিবকে দেখে বিষ্ণু আনন্দে এতটাই উদ্বেল হয়ে উঠলেন যে, তাঁর উচ্ছিষ্ট খাবার মুখ থেকে কিছুটা ভূমিতে পড়ে গেল। ভগবান বিষ্ণুর উচ্ছিষ্ট অমৃতের তুল্য। তাই তা ভূমি থেকে পরম ভক্তিভরে তুলে নিয়ে শিব মুখে দিলেন। অনবধানতাবশত সেই উচ্ছিষ্টেরই একটি কণা শিবের ঠোঁটের বাইরে লেগে রইল। শিব বা বিষ্ণু দুজনের কেউই তা আর খেয়াল করলেন না। খানিক পরে সেই অবস্থাতেই শিব বিষ্ণুর সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে ফিরলেন কৈলাসে। সেখানে তখন তাঁর দর্শন পাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন দেবর্ষি নারদ। বিষ্ণুভক্ত নারদ দেখতে পেলেন শিবের ঠোঁটে লেগে থাকা আহারের কণা। ধ্যানযোগে বুঝলেন সেই কণা তাঁরই ইষ্টের প্রসাদ। অমনি তিনি তা গ্রহণ করে মুখে দিলেন।

শিবের ঠোঁট থেকে কণা গ্রহণ করতে দেখলেন পার্বতী। তাঁর ভীষণ কৌতূহল হল ব্যাপারটা দেখে। তখন নারদকে জিজ্ঞেস করে সেই কণার রহস্য জানতে পারলেন তিনি। অমনি তাঁর ভারি আফসোস হল। শিব, নারদ যে অমৃততুল্য প্রসাদ পেয়ে ধন্য হলেন তা থেকে তিনিই কিনা বঞ্চিত হলেন! তাঁর এই আফসোস তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে নিবেদন করলেন। ভগবান বিষ্ণু পার্বতীর মধ্যে প্রিয় ভক্তের আকুতি দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন। স্মিত মুখে বললেন যে, কষ্ট পেও না দেবী, আমি আর হর তো আলাদা নই। আমরা যে হরিহরমূর্তিতে অভিন্নতা প্রকাশ করেছি, সে তো তোমার অজ্ঞাত নয়। তুমি এও জানো যে, যারা আমাদের যেভাবে ভজনা করে, তাদের আমরা সেভাবেই দর্শন দিই, কৃপা করি। তুমি হরের প্রসাদ পাও, ওতে তো আমার স্পর্শও থাকে। তবু তুমি যখন কষ্ট পেয়েছ, আফসোস হয়েছে যখন তোমার; তখন বলি, পুরীক্ষেত্রে বিমলারূপে তোমার যে পীঠ আছে, কলিযুগে সেখানেই আমি জগন্নাথরূপে অধিষ্ঠিত হব। তখন তুমি আমার প্রসাদ নিত্যভোগ হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ পাবে। আর আমার সঙ্গে হর সেখানে ওতপ্রোতভাবে অধিষ্ঠান করবেন এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমিই হব তোমার সেই পীঠের ভৈরব। এবার তুমি খুশি তো!

হ্যাঁ, ভগবান বিষ্ণুর এমনতর কৃপায় দেবী পার্বতী অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন সেদিন। সেই কৃপা আর আনন্দের ধারা বয়ে চলেছে আজও পুরীর জগন্নাথমন্দির প্রাঙ্গণে। আমরা ভক্তজন তারই স্পর্শ পেয়ে, দর্শন পেয়ে ধন্য হই তৃপ্ত হই; তারই টানে সেখানে আমরা বার বার ছুটে যাই।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...