বাংলার দিকে দিকে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র ডাকাত কালী মন্দির। তার মধ্যে অন্যতম ভালিয়া ডাকাত কালী মন্দির। যা তেলো-ভেলোর ডাকাত কালী মন্দির নামে জনপ্রিয়। হুগলির মায়াপুর স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে রয়েছে এই মন্দির। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও মা সারদা।
আরামবাগে রয়েছে তেলো ভেলোর মাঠ। তেলো ও ভেলো হল পাশাপাশি অবস্থিত দুই গ্রাম। একদা তেলো ভেলো ছিল ডাকাতদের ঘাঁটি। কথিত আছে, একদিন মা সারদা ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণের কাছে দক্ষিণেশ্বরে আসার জন্য পায়ে হেঁটে কামারপুকুর থেকে রওনা দেন। পথে ক্লান্ত মা সারদা তেলো ভেলোর মাঠে ডাকাতদের খপ্পরে পড়েন। ডাকাত সর্দার মা সারদার মধ্যে নিজের আরাধ্য দেবী মা কালীর দর্শন পান। সে রাতে মা সারদাকে তারা আশ্রয় দেন। মুড়ি, মুড়কি ও চালভাজা দিয়ে আপ্যায়ন করেন ডাকাত সর্দার ভিমে ডাকাত ও তার স্ত্রী। ডাকাত সর্দারের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরই ভালিয়ার ডাকাত কালী মন্দির নামে জনপ্রিয়। এখানে এখানে মায়ের নিত্য পুজো হয়। নিত্য ভোগের সঙ্গে মুড়ি, মুড়কি ও চালভাজা দেওয়া হয়।
বাংলার ১২৮০ সন, ৩ চৈত্র শ্রীশ্রী মা সারদামণিদেবী রওনা দিয়েছেন কামারপুকুর থেকে, গন্তব্য দক্ষিণেশ্বর। তিনি যাবেন পায়ে হেঁটে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের শরীর অসুস্থ, তাই মা উদ্বিঘ্ন। কয়েকজন যাত্রী গঙ্গাস্নান করার উদ্দেশ্যে কামারপুকুর থেকে কলকাতার পথে যাচ্ছিলেন। মা ও তাঁর ভাসুরপো শিবরাম এবং লক্ষীমণিদেবী সঙ্গে নিয়ে তাঁদের সঙ্গী হন।
কামারপুকুর থেকে আরামবাগ কয়েক মাইলের পথ। আরামবাগ থেকে তারকেশ্বরের মধ্যে পড়ে তেলো ভেলোর মাঠ, ডাকাতদের ডেরা। পথ হেঁটে মা সারদা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ডাকাতদের খপ্পরে পড়তে হবে ভেবে মায়ের সঙ্গী মহিলারা ভয় পান। তাঁরা তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকেন। মা বলেন তাঁর কথা না ভেবে সঙ্গীরা যেন এগিয়ে যান। তারকেশ্বরে সবার সঙ্গে দেখা হবে। তেলো ভেলোর মাঠে যখন মা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন, তখন মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় ডাকাত সর্দার ভীম। মা সারদা তাঁকে দেখে বিচলিত হননি। তিনি বলেন তোমার মেয়ে গো বাবা, আমি সারদা। যাচ্ছি তোমার জামাইয়ের কাছে দক্ষিণেশ্বর। ভীমে সর্দার দেখতে পান তেলো ভেলোর মাঠ যেন অদ্ভুত আলোর জ্যোতিতে ভরে গেল। মা সারদার মধ্যে ডাকাত সর্দার ভীম নিজের আরাধ্য দেবী মা কালীকে দেখতে পান। তিনি মা সারদাকে নিজেদের কুটিরে নিয়ে যান। ঘরে থাকা মুড়িমুড়কি ও চালভাজা খেতে দেন মা সারদাকে। তৃপ্তি করে খেয়ে মাটির দাওয়াতেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন মা সারদা। পরদিন ভোরে ডাকাত সর্দার ভীম নিজেই মা সারদাকে তাঁর সঙ্গীদের কাছে পৌঁছে দেন। সর্দার ভীম মনে করেন, বহু জন্মের পূণ্য ফলে মা ভবতারিণী স্বয়ং এসেছেন তার কাছে। তারপরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন কালী মন্দির। ডাকাতি ছেড়ে দেন। তারা বেশ কয়েকবার দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ডাকাতের নাম ছিল সাগর সাঁতরা এবং তার স্ত্রী মাতঙ্গিনী। তাদের দুই ছেলে বিহারী ও মেহারী শ্রীমায়ের কাছে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন।
আষাঢ় মাসের অমাবস্যার তিথিতে আরামবাগের তেলো ভেলোর মাঠে মন্দিরে আজও মায়ের বাৎসরিক পুজো হয়। আষাঢ় মাসের অমাবস্যার দিন, দিনের বেলায় প্রচুর ভক্তরা আসেন। এই দিন মাকে রক্ষাকালী রূপে পুজো করা হয়। পুজোয় মহিষ, মেষ এবং ছাগ বলিদান হয়।
মন্দিরের সামনে একটি ঘরের মধ্যে বলি স্থান আছে। ছাগ ও মহিষের আলাদা আলাদা বলি দেওয়ার হাড়িকাঠ রয়েছে। দীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে মায়ের নিশি পুজো হয়ে। বহুকাল আগে এই এলাকা ছিল জঙ্গলে ঘেরা। ভয়ে কেউ যেতেন না। দিনের বেলায় তড়িঘড়ি পুজো করে যে যার বাড়ি ফিরে যেত। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দিরে আগে নরবলি হত। এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। গড়ে উঠেছে সারদা-মঠ মিশন। প্রতিদিন মায়ের নিত্য পুজো হয়।
পুরোন কালী মন্দির সংস্কার হয়েছে। নতুন কালীমন্দির তৈরি হয়েছে। মন্দিরটি নির্মাণ করেছে ডালিয়া সারদা সংঘ। পাশাপাশি দুটি ঘরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে মা সারদার মর্মর মূর্তি এবং লাঠি হাতে ভীম সর্দারের মূর্তি। নতুন মন্দির থেকে ৫০ মিটার দূরে নির্জনে রয়েছে প্রাচীন কালী মন্দির। মন্দিরটি ২০১০ সালে সংস্কার করা হয়েছে। গোলাপী রঙের এক রত্ন মন্দির। মাটি থেকে মন্দির বেশ উঁচুতে অবস্থিত। গর্ভগৃহে তিন ফুট উঁচু বেদীর উপর চারফুট উচ্চতার মা দক্ষিণাকালীর বিগ্রহ রয়েছে। মা কৃষ্ণবর্ণা। মায়ের ডান হাতের বরাভয় মুদ্রা যেন সকলকে কৃপা করে।