সঙ্ঘ জননী, গুরুপত্নীর পরিচয়ের বেড়াজাল পেরিয়ে শ্রীমা সকলের মা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নিজের কথায় সত্যিকারের মা। বাংলার ভয়ঙ্কর ডাকাত থেকে ভিনদেশী রমণী, সকলের মা হয়ে উঠেছিলেন সারদা। দেশের বিপ্লবীদের জন্যে উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁর মাতৃত্বের ভাণ্ডার। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ লিখে গিয়েছেন, "ওই শান্ত সমাহিত নীরব জীবনের মধ্যেই রয়েছে অতিবিপ্লবের বীজ। রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ; এই ত্রয়ী এক মহাবিপ্লবের প্রতীক।"
শ্রীমা সারদাদেবী কাছে কে সন্তান স্নেহ পাননি? শ্রীঅরবিন্দ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, বাঘাযতীন, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ। শিখাময়ী নিবেদিতাও ভারতসেবার মন্ত্র পেয়েছিলেন মায়ের থেকে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। বিপ্লবী বিধবা নারী, ননীবালা কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তখন অনশন করছেন। জনমত তাঁর দিকে। পুলিশের সুপারিনটেন্ডেন্ট গোল্ডি ননীবালাকে ডেকে বললেন "আপনি আহার গ্রহণ করুন, তার জন্য আপনার যেকোনও ইচ্ছাপূরণ করব।" ননীবালাদেবী বলেছিলেন, "আমায় বাগবাজারে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্ত্রীর কাছে রেখে। তাহলেই খাব।" এতটাই শক্তির উৎস ছিলেন মা। আর তাঁর শক্তির আধার ছিলেন পরমহংসদেব। বিপ্লবী প্রিয়নাথ দাশগুপ্তকে শ্রীমা বলেছিলেন, "ভয় করো না, ঠাকুর সব ঠিক করে দেবেন।"
বহু বিপ্লবী তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছেন, পরবর্তীতে দীক্ষিত হয়েছেন। মানিকতলা বোমা মামলায় জড়িত দুই বিপ্লবী রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে যোগ দিয়েছিলেন কেবল সারদা মায়ের ইচ্ছায়। তাঁরাই হয়ে ওঠেন স্বামী প্রজ্ঞানন্দ ও স্বামী চিন্ময়ানন্দ। পূর্বাশ্রমে তাঁরা ছিলেন দেবব্রত বসু ও শচীন্দ্র নাথ সেন। অনুশীলন সমিতির আরও যেসব সদস্য শ্রীমায়ের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে মঠে যোগদান করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছে, নগেন্দ্রনাথ সরকার (স্বামী সহজানন্দ), প্রিয়নাথ দাশগুপ্ত (স্বামী আত্মপ্রকাশানন্দ), রাধিকামোহন গোস্বামী (স্বামী সুন্দরানন্দ) সতীশ দাশগুপ্ত (স্বামী সত্যানন্দ) ধীরেন দাশগুপ্ত (স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ), অতুল গুহ (স্বামী অভয়ানন্দ বা ভরত মহারাজ) প্রমুখ।
১৯০৯ সালে, আলিপুর বোমা মামলার রায়ের পর বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে বিপ্লবীদের ঢল নেমেছিল। মায়ের আশীর্বাদ নিতে এসেছিলেন সবাই। সে সময়ের প্রায় সব জাতীয়তাবাদীই মায়ের শ্রীচরণ স্পর্শ করে যেতেন। ১৯০৯ সালের ২২ জুলাই মিস ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে নিবেদিতা লিখছেন, "সব দলগুলিই ঐক্যবদ্ধ হইয়া বলিতেছে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিকট হইতে নূতন প্রেরণা আসিতেছে। কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করিয়া দলে দলে সকলে শ্রী মাকে প্রণাম করিয়া যাইতেছে।" স্বদেশী ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় বহু তরুণ বিপ্লবী মঠে যোগদান করেন। কয়েকজন বিপ্লবী মায়ের কাছে দীক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিভূতিভূষণ ঘোষ, বিজয়কৃষ্ণ বসু, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, রজনীকান্ত প্রামাণিক প্রমুখের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। বিপ্লবী যোগেন্দ্র নাথ গুহঠাকুরতার মেয়ে প্রফুল্লমুখী দেবীও মায়ের কাছে মন্ত্র দীক্ষা পেয়েছিলেন। ঢাকার স্বাধীনতা সংগ্রামী, শ্রীমায়ের ভক্ত রাজেন্দ্রভূষণ গুপ্তের কন্যা গিরিজা গুপ্ত শ্রীমায়ের কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেন। ১৯১৪-এর ২২ এপ্রিল সি.এ চার্লস টেগার্টের একচল্লিশ পৃষ্ঠার নোটে ছিল রাজনীতির সঙ্গে মিশনের কোনও যোগাযোগ নেই, একথা তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেননি। এমনকি জ্ঞানানন্দকে নজরবন্দি করেছিল ইংরেজরা। ১৯১৬ সালে বেলুড় মঠ রাজরোষে পড়ল। মা সাফ বলে দিলেন, ঠাকুরের আশ্রয় পাওয়া সন্ন্যাসীদের তিনি ত্যাগ করতে পারবেন না। বড়লাটকে সব কথা বুঝিয়ে বলতে লোক পাঠালেন। বড়লাটের আদেশ প্রত্যাহার হল।
গোড়া থেকে বলি, ১৯১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তাঁর ভাষণে রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে বললেন, দেশে সন্ত্রাসীবাদী তরুণ ও যুবকেরা রামকৃষ্ণ মিশনের মদতপুষ্ট। মিশনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের আনুকূল্যে এবং ত্রাণকার্য করার ছলে প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের প্রভাবিত করে যাচ্ছে। দেশবাসী যেন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁদের ছেলেদের যোগাযোগ যা কি-না রাষ্ট্রদোহিতার নামান্তর, সে ব্যাপারে সাবধান হন। গভর্নরের মন্তব্যে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।
মঠ ও মিশন থেকে অনেকের বহিষ্কারের দাবি উঠেছিল। মঠ ও মিশনের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন দক্ষিণ ভারতে। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক স্বামী সারদানন্দ সারদাদেবীর কাছে ছুটলেন। শ্রীশ্রী মা বলেছিলেন, "ও মা! এ সব কী কথা! ঠাকুর সত্যস্বরূপ। যে সব ছেলে তাঁকে আশ্রয় করে তাঁর ভাব নিয়ে সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছে, দেশের, দশের ও আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে, সংসারের মুখে জলাঞ্জলি দিয়েছে, তারা মিথ্যাভাষণ কেন করবে বাবা? স্বামী সারদানন্দকে মা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ঠাকুরের ইচ্ছেয় মঠ-মিশন হয়েছে। রাজরোষে নিয়ম অলঙ্ঘন করা অধর্ম। ঠাকুরের নামে যারা সন্ন্যাসী হয়েছে তারা মঠে থাকবে নয়তো কেউ থাকবে না। তাঁর ছেলেরা গাছতলায় আশ্রয় নেবে। তবু সত্যভঙ্গ করবে না। তুমি লাটসাহেবের সঙ্গে দেখা করো। তিনি রাজপ্রতিনিধি। তোমাদের সব কথা তাঁকে বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই শুনবেন।" মায়ের পরামর্শে কাজ হয়েছিল।
১৯১৭ সালে স্বদেশি মামলা অভিযোগে যুথবিহার গ্রামের দেবেনবাবুর আসন্নসম্ভবা স্ত্রী ও বোনকে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বাঁকুড়া থানায় বন্দি করেছিল পুলিশ। মা বলেছেন, "এমন কোনও বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না যে দু’চড় মেরে মেয়ে দু’টিকে ছাড়িয়ে আনতে পারত?" বিপ্লবী বাঘা যতীনও মায়ের স্নেহ পেয়েছিলেন। ১৯১৫ নাগাদ পলাতক অবস্থায় যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মায়ের ট্রেন সফরের কথা জানতে পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাগানানে মায়ের সঙ্গে দেখা করেন। কথা হয়। সে সাক্ষাৎ সম্পর্কে মা বলেছিলেন, "দেখলাম আগুন!" বাঘাকে মা প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে গিয়েছেন। বাইরের পুরুষ সঙ্গে মা সরাসরি দেখা করতেন না। কথা বলতেন অন্যের মাধ্যমে। বাঘাযতীনের ক্ষেত্রে মা তা মানতেন না। যেন তাঁর কোলের ছেলে।
জয়রামবাটির কিছু দূরেই কোয়ালপাড়া গ্রাম। কোয়ালপাড়া মঠে ছেলেদের ও অন্যদেরও চরকায় সুতো কাটা, তাঁত বোনার পরামর্শ দিতেন। কোয়ালপাড়া আশ্রমের ছেলেদের বলতেন, "বাবা, তোমরা বন্দেমাতরম্ করে হুজুগ করে বেড়িও না তাঁত কর, চরকা কর, আগে তো তাঁতের কাপড়ই সবাই পড়ত, চরকা পেলে আমিও সুতো কাটি।" প্রসঙ্গত, মায়ের পিতৃদেব কার্পাস চাষ করতেন। সুতো দিয়ে পৈতে গড়ে বিক্রি করতেন। মায়ের সমর্থনেই মুর্শিদাবাদের সারগাছি আশ্রম তরুণ দেশসেবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের তীর্থস্থান হয়ে উঠেছিল। কোয়ালপাড়া মঠেও পুলিশের কড়া নজর ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালে, খাদ্যাভাব ও বস্ত্রাভাব চরমে ওঠে দেশে। মেয়েরা বস্ত্রাভাবে বাইরে বের হতে পারছে না। এক টুকরো কাপড়ের জন্য কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে। দিকে দিকে হাহাকার। মা বললেন, "কাপড় না পেলে কী করবে গো? তখন ঘরে ঘরে চরকা ছিল, ক্ষেতে কাপাস চাষ হত, সকলেই সুতো কাটত, নিজেদের কাপড় নিজেরাই করিয়ে নিত, কাপড়ের অভাব ছিল না। কোম্পানি এসে সব নষ্ট করে দিলে। কোম্পানি সুখ দেখিয়ে দিলে টাকায় চারখানা কাপড়, একখানা ফাও। সব বাবু হয়ে গেল চরকা উঠে গেল। এখন বাবু সব কাবু হয়েছে।আমাকেও একখানা চরকা এনে দাও, আমিও সুতো কাটব।" কত গভীর স্বদেশ ভাবনা লুকিয়ে এ কথায়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীরা মায়ের কাছে আসতেন প্রাণশক্তি লাভ করার জন্য, বিপ্লবীরা মায়ের কাছে আসতেন আশীর্বাদ নিতে। বিপ্লবীদের কাউকে মা নিরাশ করেননি। কাউকে ফেরাননি। ঠাকুরের কথা সত্যি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের মা।