পাতালের এক অসুর ছিলেন মা কালীর ভক্ত। ছোট থেকে একটাই তপস্যা ছিল তাঁর, দেবী কালীর আশীর্বাদ পাওয়া। একবার তিনি কঠিন তপস্যা শুরু করেন। একনিষ্ঠ সাধনায় ব্রতী হন সেই অসুর। মা কালী তাঁর ভক্তের এই আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিতে আসেন। একটাই বর চেয়েছিলেন সেই অসুর। অসুর কোনও বিপদে পড়লে যেন দেবী কালী তাঁকে নিজে এসে রক্ষা করেন। ভক্তের এটুকু প্রার্থনা খুশি হয়েই আশীর্বাদ রূপে দিয়েছিলেন দেবী কালী। কিন্তু সেই অসুরের আসল অভিসন্ধি ছিল অন্য। স্বর্গের অধিপতি হতে চাইতেন তিনি। দেবী কালীর আশীর্বাদ পেয়ে সেই অসুর চরম অত্যাচার চালাতে শুরু করেন। স্বর্গের দেবতাদের রীতিমতো তিষ্ঠোতে দিচ্ছিলেন না। ইন্দ্র, বিষ্ণু এবং অন্যান্য দেবতারা মিলে পরামর্শ করে ঠিক করেন এর প্রতিকার যদি কেউ করতে পারে তা হলো স্বয়ং ভগবান শিব। তখন দেবতারা ভগবান শিবের কাছে গেলেন। দেবতারা মহাদেবকে রাজি করালেন ওই অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। দেবতাদের কাছ থেকে সব শুনে এবং দেবতাদের অনুরোধে মহাদেব রাজি হয়ে যান অসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
এদিকে সেই অসুরও মহা ধুরন্দর। মহাদেবকে আসতে দেখেই তিনি ভয় পেয়ে দেবী কালীকে আহ্বান জানান। মা কালী ওখানে উপস্থিত হন অসুরের আরাধনায়। উপস্থিত হয়ে চমকে ওঠেন উনি। তিনি দেখেন ভক্তকে রক্ষা করার জন্য স্বয়ং স্বামী মহাদেবের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। নিরুপায় হয়ে দেবী কালী স্বামীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। কারণ তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভক্তকে রক্ষার কর্তব্য সকলের আগে। মহাদেবও সহজে হার মানতে রাজি হননি। বারবার দেবী কালীকে বলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সৃষ্টিকে রক্ষা করতে এই অসুরকে ধ্বংস করা জরুরী। দেবী কালীও নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসেননি। শিব ও কালীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাঁধে। সৃষ্টি তোলপাড় হওয়ার মুখে চলে আসে। সমান অথচ বিপরীতমুখী শক্তির এই সংঘর্ষে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল রীতিমত আন্দোলিত হয়। মহাদেব কালীর রাগ জানেন। তিনি জানেন, দেবী কালী রেগে গেলে সব ধ্বংস করে দিতে পারেন, ভগবান শিব তখন আত্মসমর্পণ করেন। এদিকে রাগে অন্ধ হয়ে রয়েছেন দেবী কালী।
ভক্ত অসুরকে রক্ষা করতে মা কালী মহাদেবকে গিলে খেয়ে ফেলেন। শিবের এই পরিণতির পর স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার। মা কালী তখন বুঝতে পারেন তিনি নিজের স্বামীকে গিলে খেয়ে ফেলেছেন। আত্মদগ্ধ হতে হতে অসংলগ্ন হয়ে পড়েন তিনি। দেবীর এই অসংলগ্ন রূপকেই উত্তরবঙ্গে মা পাগলী হিসেবে পুজো করা হয়।
পাগলি দেবী মা কালীরই লৌকিক রূপ। এই দেবীর পুজোর থান রয়েছে আলিপুরদুয়ার জেলার মধ্য-কামাখ্যাগুড়ির মা কামাখ্যা ধামে এছাড়া কোচবিহার জেলার বক্সিরহাট থানার রসিকবিলের টাকোয়ামারি গ্রামে। টাকোয়ামারিতে যেখানে পাগলি দেবীর থান সেই এলাকাটার নাম ও পাগলী দেবীর নাম অনুসারে পাগলী কুঠি হয়েছে। প্রথমে ঘট রেখে পুজো করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যখন এই পুজোর জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। তখন স্থানীয় এক রাভার ওপর ভর হয় পাগলি দেবীর। সেই ভরের পর এই কমিটির সদস্য দুর্লভ রাভা বলেন পাগলি দেবী স্বয়ং এসে তাঁকে পুজোর মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। সেটা বৈদিক মন্ত্র নয়। আগে এই পুজো হতো আষাঢ় মাসে, অম্বুবাচীর সময়। প্রথমদিকে মূর্তি পূজোর চল ছিল না। পুজোর উপকরণ দেওয়া হতো সুপারি, পান, পয়সা, ধান, আমের পল্লব, কলার পাতা, ডাব, লালশালু আর বেলপাতা। এছাড়াও মাটির প্রদীপ, দুধ, চিনি, কলা আর আতপ চাল দেওয়া হয়। পাশাপাশি উৎসর্গ করা হয় সিঁদুর লেপা পাঁচটা ফুল। ধূপ, ধুনো জ্বালানো হয়।
ঘট স্থাপন করে পুজো শুরু হয়। কয়েক বছর এভাবেই চলে। তারপর পুরোহিত দুর্লভ রাভা একদিন স্বপ্নে দেখেন একজন বিধবা মহিলা পায়ের নুপুর পরে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। পরপর কয়েকদিন এই একই স্বপ্ন দেখতে থাকেন তিনি। এমনকি গ্রামের আর কয়েকজন ও সেই বিধবা মহিলাকে স্বপ্নে দেখতে থাকেন। তখন পুজো কমিটির সদস্যরা ঠিক করেন এরকম একটি মূর্তি গড়িয়ে তারা পাগলী দেবীর একটি থান তৈরি করে তাতে পুজো শুরু করবেন।
পাগলী কুঠির থানের জন্ম হয়েছিল এভাবেই। পাগলী মায়ের পুজোর পূজারীকে দেউসি বলা হয়। একজন দেউসী মারা গেলে কিংবা পুজো করা থেকে অবসর নিলে পাগলী মা নিজে আগের দেউসীকে ছেড়ে স্থানীয় আর একজন কারোর উপর ভর করে সেই ব্যক্তিকে নতুন দেউসী নিজে নির্বাচন করেন। পাগলী কুঠির মা পাগলী থানে নিত্য পুজোর কোন চল নেই। বছরে একবার মাত্র পুজো করা হয়। পূজোর প্রসাদ বলতে খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট এবং পায়েস। পাগলী কুঠিতে এই পুজো ঘিরে একটা ছোট মেলাও বসে। পাগলীকুঠিতে পাগলী মায়ের পুজো পিছিয়ে বর্তমানে কালীপুজোর সময় হয়। আসলে এই মা দেবী কালীর লৌকিক রূপ তাই পরবর্তীকালে পুজো পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মধ্য কামাখ্যাগুড়ির মা কামাখ্যা ধামে পাগলি দেবীর যে মূর্তি রয়েছে সেটা কালো। তার আলু থালু লম্বা চুল, পরনে শাড়ি। এইখানে প্রতিবছর আষাঢ় মাসে মহামেলার সময় পাগলী মায়ের পুজো করা হয়। এখানে প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী মা পাগলী ভর করলে নাকি মানুষ পাগল হয়ে যায়। তখন মা পাগলীর কাছে মানত করলে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হয়ে ওঠে। এই থানে পূজোর সময় নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় দুধ, কলা, ফলমূল, সাদা কাপড়। এখানে মা পাগলীর হাতে থাকে লাঠি। প্রতিবছর মা পাগলীকে নতুন লাঠি উৎসর্গ করতে হয়। এখানে পাঁঠা বলি আর পায়রা বলির চল রয়েছে। উত্তরবঙ্গের লৌকিক দেবী হিসেবে মা পাগলী সকলের কাছে অত্যন্ত পরিচিত।