কালী কথা: গোবরডাঙ্গার প্রসন্নময়ী কালী মন্দির

আগের সপ্তাহে কালী কথায় আমরা দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাতালভেদী মন্দিরে শেষ করেছিলাম। চলুন আজ উত্তরে পাড়ি জমাই। যদিও উত্তর এবং দক্ষিণে ভাগ হওয়ার আগে থেকেই এটি ছিল অভিভক্ত ২৪ পরগনা। ২৪ পরগনার ঐতিহ্যবাহী জনপদ হল গোবরডাঙ্গা। এই বঙ্গে রাজা-মহারাজা-জমিদারদের নিজস্ব মন্দির প্রতিষ্ঠা করার এক ঐতিহ্য দেখা যায়। সাধারণ মানুষদের কুলদেবতা থাকেন, আর এরা তো কেউকেটা ব্যক্তি, এদের তো থাকবেই।

রাজা, মহারাজা, জমিদারদের প্রতিষ্ঠা করা দেবদেবীদের অজস্র মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে সারা বাংলা জুড়ে। তেমনই এক কালী মন্দিরের গল্প আজকের কালীকথায়। শিয়ালদা-বনগাঁ শাখার অন্যতম এক ব্যস্ত স্টেশন এই গোবরডাঙ্গা। কথায় বলে টাকির জমিদারের লাঠি আর গোবরডাঙ্গার জমিদারের হাতি। হাতি পোষার সখের জন্যই গোবরডাঙ্গার জমিদারদের সুখ্যাতি ছিল। তাদের আন, বান আর শান অর্থাৎ ঠাটবাট প্রদর্শনের নিদর্শন ছিল এই হাতি। আজও গোবরডাঙ্গার সাড়ে তিন নম্বর প্যাল্টফর্মটি সেই ইতিহাসের নজির বহন করে চলেছে।

আজও জমিদারবাড়ি, রাজবাড়ি, কাছারি বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, বাওড় সবই গোবরডাঙ্গার ঐতিহ্য এবং প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সংস্কৃত শব্দ থেকে গোবরডাঙ্গার উৎপত্তি হয়েছে, তিনটি পৃথক অংশ মিলিত হয়ে তৈরি যার অর্থ হল এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জায়গা। গোবরডাঙ্গার নামকরণ নিয়ে একাধিক কিংবদন্তি শোনা যায়। যাক সে অন্য কথা।

আমরা কালী কথা শুরু করি। গোবরডাঙ্গার রাজবাড়িতে জাঁকজমকপূর্ণভাবে দুর্গা পুজো হয়। দুর্গা মায়ের পাশাপাশি রাজ পরিবার মা কালীরও কৃপা দৃষ্টি লাভ করে ছিল। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শহর গোবরডাঙ্গায় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কালী মন্দির অবস্থিত। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোবরডাঙ্গা শহরের বিখ্যাত এই কালীমন্দিরের নাম মা প্রসন্নময়ীর মন্দির। আদপে কালী মায়ের নামই মা প্রসন্নময়ী। সেই থেকে তাঁর নামেই মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে।

 

Gobardanga1

 

এই মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে এক কাহিনী। মনবাঞ্ছাপূরণের কাহিনী বলাই শ্রেয়। গোবরডাঙ্গার জমিদার মুখোপাধ্যায় বংশের সঙ্গে এই মন্দিরের ইতিহাস মিশে গিয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই মুখার্জী পরিবার। অবিভক্ত বাংলা জুড়েই মুখার্জী পরিবার তাদের জমিদারি স্থাপন করেছিল।

প্রথমে নদিয়া জেলা, পরবর্তীতে আধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন খেলারাম মুখোপাধ্যায়। সবশেষে উত্তর ২৪ পরগণার গোবরডাঙ্গা গ্রামে জমিয়ে বসেনে জমিদার খেলারাম মুখোপাধ্যায়। খেলারাম  মুখোপাধ্যায়ই মুখার্জী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি দু'বার বিবাহ করেছিলেন।

তাঁর প্রথমা স্ত্রী ছিলেন যশোহর জেলার ক্ষেত্রপাড়া গ্রামের আনন্দময়ী দেবী। এই আনন্দময়ী দেবীর গর্ভেই জন্মলাভ করেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বৈদ্যনাথ নিজে নিঃসন্তান ছিলেন, ১৮২২ সালে অপুত্রক অবস্থায় বৈদ্যনাথ  মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছিল। আনন্দময়ী দেবীর পরে নদিয়া জেলার ধর্মদহ গ্রামের কন্যা দ্রৌপদী দেবীকে বিয়ে করেনছিলেন খেলারাম মুখোপাধ্যায়।

খেলারাম মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া স্ত্রীয়ের গর্ভে কোন পুত্রসন্তানের আর জন্ম হচ্ছিল না। পুত্র সন্তানের জন্ম না হলে মুখোপাধ্যায় বংশ এগোবে কী করে, এই চিন্তায় কষ্ট পাচ্ছিছিলেন খেলরাম। ঠিক সেই সময়তেই এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে খেলরামের দেখা হয়। সন্তান লাভের জন্য ওই সন্ন্যাসী খেলারামকে কালী মায়ের আশীর্বাদ স্বরূপ একটি ফল দেন। ফলটি ছিল কালী মায়ের পুজোর প্রসাদ। ফল সেবন করেই সুফল পান খেলরামের দ্বিতীয়া স্ত্রী। সন্তানসম্ভবা হন, দ্রৌপদী দেবীর কোল আলো করে ১৭৯৪ সালে খেলারাম মুখোপাধ্যায়ের একটি পুত্র সন্তান হয়। কালী মা প্রসন্ন হয়ে, এই পুত্রসন্তান জন্ম হওয়ায় সেই পুত্রের নাম রাখা হয় কালীপ্রসন্ন। মা কালী প্রসন্নময়ীর আশীর্বাদে জমিদারের ছেলে হলে তার নাম রাখা হল কালীপ্রসন্ন।

কালী মায়ের কৃপায় পুত্রসন্তান লাভ করার পরে, খেলরাম  মায়ের স্বপ্নাদেশ পান। মা স্বপ্নে এসে ইঙ্গিত দিলেন, তিনি যমুনা নদীতেই আছেন। সেই স্বপ্নাদেশ মেনে পরদিন ভোরেই যমুনা নদীতে ডুব দিয়ে মিলল বড়সড় কষ্টিপাথর। সেই পাথর থেকেই মূর্তি গড়ার কাজ শুরু হল। খেলারাম মুখোপাধ্যায় এই কালীমূর্তি এবং কালীমন্দির  স্থাপনে উদ্যোগী হন। মন্দিরের কাজ খেলারাম শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেননি। মন্দিরের নির্মাণ কার্য শেষ হওয়ার আগেই খেলারামের মৃত্যু হলে, তাঁর ছেলে কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন।

 

Gobardanga2

 

বাংলা সন অনুযায়ী, ১২২৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ, ইংরেজি ১৮২২ সালের ১১ই এপ্রিল এই প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। কালীবাড়ির উদ্বোধন করেন জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। স্বপ্নাদেশ থেকেই এ বাড়ির পুজো শুরু হয়। খেলারাম মুখোপাধ্যায় পুজো শুরু করেন। পরে কালীপ্রসন্নই এইপুজোর ধারা বয়ে নিয়ে যান। সেই থেকে আজও হয়ে চলেছে এই পুজো। মুখোপাধ্যায় পরিবারের আরাধ্যা দেবী হলেন মা প্রসন্নময়ী, প্রসন্নময়ী মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রত্যেক পুরুষের নামের সঙ্গে প্রসন্ন শব্দটি সংযুক্ত করা হয়।

সময়কালটি লক্ষ্য করুন ১২২৯ সন এরও প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে তৈরি হল দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণী মন্দির। জমিদার বাড়ির বংশধরদের কথায়, এখানকার কালী মন্দির দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠারও ৩৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কথিত আছে, রাণী রাসমণি দেবী একবার এই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রসন্নময়ী মায়ের মন্দিরে এসেছিলেন।

এই মন্দিরের আদলেই দক্ষিণেরশ্বর কালী মন্দির স্থাপন করা হয় বলেই প্রচলিত রয়েছে। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির নবরত্ন মন্দির, রানী রাসমণি বহু মন্দির দেখে তারপর দক্ষিণেশ্বরের মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। এতে একাধিক মন্দিরের স্থাপত্যরীতির অনুকরণ করা হয়েছে। মা প্রসন্নময়ীর মন্দিরের সঙ্গেও একাধিক মিল রয়েছে দক্ষিণেশ্বরের। এমনকি মন্দিরের বর্ণও মিলে যায়। ১২টি শিব মন্দির নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কালীমন্দির। মন্দিরের মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দুটি সারিতে পূর্বমুখী ছয়টি ও পশ্চিমমুখী ছয়টি মোট বারোটি আটচালা শিবমন্দির আছে। প্রতিটি মন্দিরে শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত এবং প্রত্যেকটি মন্দিরেই নিত্য পুজো চলে। এছাড়াও মন্দিরে ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি ও চৈত্র মাসে শিবরে গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

রাস্তার ওপরেই জমিদার বাড়ির উল্টোদিকে, দক্ষিণে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির। অনতিদূরে বয়ে চলেছে যমুনা। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, দক্ষিণমুখী  মন্দিরটি একটি দালান ও সামনে রোয়াক নিয়ে গড়ে উঠেছে। গর্ভমন্দিরের বেদি শ্বেতপাথরের। তার উপরে শবরূপী মহাদেব বিরাজমান। শায়িত শিব শ্বেত পাথর নির্মিত। শিব এখানে দিগম্বর। শায়িত শিবের বুকের উপর দণ্ডায়মানা সুদর্শনা দেবী দক্ষিণাকালী মা প্রসন্নময়ী।

প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্টি পাথরের মা প্রসন্নময়ী দেবী মন্দিরে বিরাজমানা। দেবী নানান সোনা-রুপোর অলংকারে ভূষিতা। মন্দিরটি খুবই বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। লোক বিশ্বাস মতে, এখানের মা খুবই জাগ্রত। এখানে পুজো দিলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। প্রতিদিন সকাল ও বিকালে নিত্যপুজো চলে। সন্ধ্যায় মায়ের আরতি হয় ও নানা রকম বাদ্যযন্ত্র বাজান হয়। দেবীর নিত্যপুজো ও সন্ধ্যারতি ছাড়াও প্রতি বছর বাংলা নববর্ষে বৈশাখে, দুর্গা পুজোর অষ্টমী তিথিতে এবং কার্তিক মাসের  অমাবস্যা তিথিতে সাড়ম্বরে পুজো হয়ে ও প্রতি শনি-মঙ্গলবারে মায়ের বিশেষ আরাধনা চলে। উৎসব উপলক্ষ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে  বিপুল সংখ্যায় জনসমাগম হয়। মন্দিরে অনেকেই শনি-মঙ্গলবারে মানসিকের পুজোও দিয়ে থাকেন।

সারাবছর এখানে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তর সমাগম হয়। তবে কালীপুজোর দিন ভিড় হয় অনেক বেশি। সারারাত ভিড় থাকে মন্দিরে। জমিদার বংশের এই প্রজন্মের পরিবারের সদস্যরা পুজোর দিনে সময় করে উপস্থিত থাকে। জাগ্রত মা, লোকের বিশ্বাস মায়ের কাছে মানত করলে মা হতাশ করেন না। কালীপুজোর দিন আগে হয় শ্যামাপূজা। আগে পশুবলি দিয়ে মায়ের পুজো আরম্ভ করা হত। এখন বলি বন্ধ। তবে এখানে এখন এক বিশেষ ধরণের বলি দেখা যায়। মধু ও চিনি বলি দেওয়া হয়! তাও নির্দিষ্ট মাপে। মা কালীর উদ্দেশ্যে পাঁচ পোয়া চিনি ও এক পোয়া মধু উৎসর্গ করা হয়।

আগে ১লা বৈশাখের সময় প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রাঙ্গণে গোষ্ঠ উৎসবের আয়োজন করা হত। আদপে যা ছিল মুখোপাধ্যায় বংশ প্রবর্তিত এক প্রাচীন  উৎসব। এই উৎসবের একটি অঙ্গ ছিল পশুর লড়াই, উৎসব উপলক্ষ্যে চারদিক ঘেরা একটি স্থানে একটি গাভি ও একটি শূকর শাবককে ছেড়ে দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হত। যতক্ষণ পর্যন্ত না গাভিটি শূকর শাবককে আক্রমণ করত ততক্ষণ এই খেলা চলত।

এই পশুর লড়াই দেখতে বহু লোকের সমাগম হত এবং এই উপলক্ষ্যে মেলা বসত। বহুদিন হল এই  খেলাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু মেলাটি আজও হয়। গোষ্ঠ উৎসব উপলক্ষ্যে ১লা বৈশাখ যমুনা নদীর তীরে এবং মুখোপাধ্যায় বাড়ির সামনে এই মেলা বসে। অবশ্য চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকেই মেলা শুরু হয়। বর্তমানে মুখোপাধ্যায় বাড়ির সামনের এই মেলায় মূলত বিভিন্ন রকমের মশলার বেচাকেনা হয়। কিন্তু মেলার নাম গোষ্ঠ মেলাই রয়ে গিয়েছে। অবশ্য লোক মুখে এটি মশলা মেলা নামেও পরিচিত। মেলায় বহু  মানুষের সমাগম হয়। জমিদারির আমল থেকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে খাজনা আদায় করা হয়, তা প্রসন্নময়ী কালীর পুজোয় ব্যবহার করা হয়।

গোবরডাঙ্গা এবং এলাকাবাসীর ঐতিহ্য গোবরডাঙ্গা প্রসন্নময়ী কালীমন্দির, বহু শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দির ও পুজো। যা আজও চলে আসছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে উপজীব্য করেই মায়ের আরাধনা হয়ে আসছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...