সৃষ্টির আদি তত্ত্বের প্রমাণিত ব্যাখ্যা নয়, মানবজীবন গড়ে উঠেছে সৃষ্টির আদিম তত্ত্বের পৌরাণিক আরাধ্য বিশ্বাসের জেরে, আর সেই বিশ্বাসের জেরেই উৎপত্তি নিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম-জাতি...... ...বিদ্বেষ, হানাহানি, ভেদাভেদ, দাঙ্গা, বিরোধ, আমরা-ওরা। ‘পৌরানিক কাহিনী, জাতি অথবা ধর্ম নয়, প্রমাণিত ব্যাখ্যা মনে রেখে মানবতার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে’ -ছোটবেলা থেকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন তিনি। মানুষ হওয়ার এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের কাছ থেকেই। স্বপ্ন দেখতেন নিজের দেশ তো বটেই, সারা পৃথিবীটাই একদিন বিশ্বাসী হয়ে উঠবে ‘মানবধর্মে’।
দীর্ঘ লড়াইয়ের পর নিজের সেই স্বপ্ন কিছুটা হলেও বাস্তব করেছেন তামিলনাড়ুর তিরুপাত্তুরের বাসিন্দা ‘এম এ স্নেহা’ ওরফে স্নেহা পার্থিবরাজা। নিজের ‘জাতি-ধর্মহীন’ প্রমানপত্র পাওয়ার জন্য ২০১০ সালেই সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন পেশায় আইনজীবি বছর পঁয়ত্রিশ(৩৫)-এর স্নেহা। টানা ৯ বছর ধরে লড়াই করে অবশেষে নিজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি স্বীকৃতি পেলেন তিনি। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিক, যিনি এ ধরনের শংসাপত্র পেলেন।
সম্প্রতি তিরুপাত্তুরের তহশিলদার টি এস সাথিয়ামুর্তি স্নেহার হাতে তুলে দেন সরকারি নথি। তাতে লেখা রয়েছে, তিনি কোনো জাতি বা ধর্মের অন্তর্গত নন। শংসাপত্র হাতে পেয়ে এক সংবাদমাধ্যমকে স্নেহা বলেন, “ জাতপাতে বিশ্বাসীরা যদি সরকার থেকে শংসাপত্র পেয়ে থাকেন, তাহলে আমরা যারা জাতি ধর্মে বিশ্বাসী নই, তারা কেন পাব না?”
শুধু স্নেহা নন, তাঁর বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বামী –কারোরই কোনও আলাদা জাতি–ধর্মের পরিচয় নেই। পরিবারের প্রত্যেকেই নিরীশ্বরবাদী, যুক্তিবাদী এবং বামপন্থী। স্নেহার মা-বাবা দু’জনই পেশায় আইনজীবী। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে স্নেহা বলেন, “আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার পরিবার বামপন্থী হওয়ায়, বাড়িতে সারাক্ষণই ‘কম্যুউনিজম’ নিয়ে আলোচনা চলত, বাড়িতে যাঁরা আসতেন বেশিরভাগই বাবা-মায়ের ‘কম্যুউনিস্ট’ বন্ধু-পরিজন। মানবতা, সাম্যবাদ(কম্যুউনিজম), যুক্তিবাদ আর নিরীশ্বরবাদ –এসবই শুধু শিখেছি, পড়েছি ছোটবেলা থেকে। আমার ভাই-বোনও একই শিক্ষায় ঋদ্ধ। “
ছোটবেলায় স্কুলে বন্ধুবান্ধব-শিক্ষক-শিক্ষিকা রা যখন তাঁদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘কোন ধর্ম বা জাতির?’ তাঁরা এক বাক্যে বলতেন, ‘আমাদের কোনও ধর্ম নেই, আমাদের কোনও জাতি নেই।‘
২০১০ সালে স্নেহার আবেদন খারিজ করে দেন সরকারি কর্মকর্তারা। কিন্তু তিনি ২০১৭ সালে আবারও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে। যেহেতু স্নেহা সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক কোনও সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগ করেন না, তাই তাঁর আবেদন গ্রহণ করতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
স্নেহাকে শংসাপত্র দেওয়া নিয়ে তিরুপাত্তুরের সাব-কালেক্টর বি প্রিয়াঙ্কা পঙ্কজাম বলেছেন, “আমরা তাঁর স্কুল কলেজের সমস্ত নথি খতিয়ে দেখেছি। সেই সব নথিতে কাস্ট ও রিলিজিয়ন এই দু’টি কলাম সব জায়গায় ফাঁকা ছিল। তাই আমরা তাঁর দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েছি। যদিও এজন্য অন্য নাগরিকদের কোনও সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হবে না তাঁকে।“
দেশে-বিদেশে সর্বত্রই জাতি অথবা ধর্মানুসারে ব্যক্তির নাম নির্ধারণ করার রীতি। স্নেহা’র পরিবার বরাবরই সেই রীতি বা প্রথা বিরোধী, তা বোঝা যায় পি ভি আনন্দকৃষ্ণন(স্নেহা’র বাবা) এবং মনিমোঝি(স্নেহা’র মা) –এঁদের সন্তানদের নামকরণের মধ্য দিয়েই। স্নেহার গোটা নাম- এম এ স্নেহা। এখানে ‘এম’ আর ‘এ’ তাঁর মা-বাবা’র নামের শুরুর অক্ষর। পদবির জায়গায় তিনি ব্যবহার করেন ‘স্নেহা’। স্নেহার দুই বোনের নাম- মুমতাজ সুরাইয়া এবং জেনিফার।
স্নেহা এই লড়াইয়ে পাশে পেয়েছেন তাঁর স্বামী তথা লেখক কে পার্থিবরাজাকে। যিনিও একই মতবাদে বিশ্বাসী। তাঁরা তাঁদের তিন কন্যাসন্তানের নাম রেখেছেন যথাক্রমে- অধিরাই নাসরিন, অধিলা ইরিন,আরিফা জেসি। নিজেদের এই পরম্পরার বীজ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিজেদের তিন মেয়ের স্কুলের ফর্মেও কোনও রকমের জাতি বা ধর্মের উল্লেখ করেন না তাঁরা।
স্নেহা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজের জায়গায় অনঢ় থেকে, লড়াই করে তা বাস্তবায়িতও করেছেন খানিকটা। শুধু স্নেহা নন, হতেও পারে একদিন সারা বিশ্বে উচ্চারিত হবে বাংলার মধ্যযুগের চারণ কবি বড়ু চণ্ডীদাস মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই মানবিক বাণী- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।