আসাম মানেই কখনো পাথুরে রুক্ষতা। আবার কখনো জঙ্গলের সবুজ ছায়া। এখন আসাম পৌঁছলে পাহাড়ি পথ বা জঙ্গলের সবুজ ছায়ায় ঠিক কি শোনা যাবে বলুন তো? পাখির ডাক, পাহাড়ি গান। বিহু নাচের ছন্দ। আর কী? আর একটা নাম। লাভলিনা বরগোঁহাই। আসামের বারোমুখিয়া গ্রামের চব্বিশ বছর বয়সী স্বপ্নের নাম লাভলিনা বরগোঁহাই।
জ্যাব। কাট। পাঞ্চ। প্রত্যেকটা স্ট্রোকেই অব্যর্থ এই বক্সার। তাঁর বুদ্ধি, পরিশ্রম, বিচক্ষণতা দিয়ে এবছরের অলিম্পিকে সে পরাজিত করেছে জার্মানির অভিজ্ঞ বক্সার নাদিন অ্যাপেট্জকে। কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছে লাভলিনা। আপাতত গোটা দেশ তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে।
তবে আসামের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে টোকিওর অলিম্পিক পর্যন্ত পথটা মসৃণ ছিল না। আসামের মতই সেই পথে ছিল রুক্ষতা। দারিদ্রের রুক্ষতা। পরিকাঠামোর অভাবের রুক্ষতা। ২৪ বছর বয়সী এই বক্সিং-কন্যা সেই সকল রুক্ষতা পেরিয়ে ছুঁতে পেরেছে সাফল্যের সবুজ সোনার কাঠি।
লাভলিনাই আসামের প্রথম বক্সার যে অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় কোয়ালিফাই করেছে।
আসামের গোলাঘাট জেলার ছোট্ট গ্রাম বারোমুখিয়া। বাসিন্দা সংখ্যা প্রায় দু'হাজার। অভাব এদের নিত্য সঙ্গী। সামাজিক উন্নতির পরিকাঠামো নেই তেমন।
গ্রামবাসীরা দেখত প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এক কিশোরী একটি অদ্ভুত খেলা প্র্যাকটিস করে। তাদের চেনা কোনো খেলা নয়। কখনো সেই কিশোরীর সঙ্গে তার দুই বোনও খেলতে আসে। সকলকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এই খেলার নাম নাকি কিকবক্সিং।
'মুয়া থাই' নামে এক বিশেষ বিভাগের মাধ্যমে প্রথমবার কিকবক্সিং শুরু করেছিল লাভলিনা। তার দুই জমজ বোন লিচা এবং লিনাও জাতীয় স্তরের কিকবক্সার।
স্কুলের সমস্ত খেলার বিভাগে অংশগ্রহণ করত লাভলিনা। খেলার জগৎ ঘিরেই ছিল তার স্বপ্ন। স্কুলের একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সে প্রথমবার শোনে বক্সার মহম্মদ আলি এবং মাইক টাইসনের নাম।
একদিন লাভলিনার বাবা একটা কাগজে মুড়ে কিছু মিষ্টি কিনে এনেছিলেন। সেই কাগজে সে আবার একবার দেখতে পেল মাইক টাইসন এবং মহম্মদ আলির ছবি। তারপর তাঁদের বক্সিং প্রতিভার কথা জানতে পারল সে।
অনেক কষ্ট করে সে সুযোগ পেল তাঁদের খেলা দেখার। টিভিতে। প্রথমবার বক্সিং নামের খেলাটার সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ অনুভব করল লাভলিনা। স্থানীয় বা স্কুলের টুকটাক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বাইরেও নিজেকে মেলে ধরার চিন্তাভাবনা শুরু হলো তার মধ্যে। পরিবারের সম্পূর্ণ সহযোগিতা ছিল লাভলিনার সঙ্গে। এমনকি গ্রামবাসীরাও তখন থেকেই তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
আসামের প্রত্যন্ত গ্রামে বক্সিং রিং, এই খেলার কোচ পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। লাভলিনা নিজের মতো করে অনুশীলন শুরু করেছিল। তার আদর্শ মাইক টাইসন এবং মহম্মদ আলি। এঁদের খেলার রেকর্ডিং দেখে অনুশীলন করত সে।
জেদ, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় লাভলিনাকে একটু একটু করে প্রস্তুত করছিল। কোন বড় লক্ষ্যের জন্য। সে যখন নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া অর্থাৎ সাইয়ের এক বক্সিং প্রশিক্ষকের নজরে আসে।
সেই প্রশিক্ষক বুঝেছিলেন এই মেয়ের অন্তর খেলার স্বপ্নে গড়া। বক্সার হিসেবে সম্ভাবনাময়। বাকিটা তাকে গড়ে-পিটে নিয়ে বক্সার হিসেবে তার যাত্রাপথ শুরু করানো সম্ভব। এভাবেই এক কিশোরী কিকবক্সার আজকের অলিম্পিক কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছনো বক্সার লাভলিনা বরগোঁহাই হয়ে ওঠে।
তারপর রাজ্য, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করে লাভলিনা। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
এ বছরের অলিম্পিক লাভলিনার কাছে স্বপ্নের। ইচ্ছের। আসামের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আহরণের। লাভলিনার সাফল্যের অপেক্ষায় সমগ্র ভারতবাসী।