বাঙালির সাত রাজার ধন এক মানিক, সত্যজিৎ। বাঙালিকে বহু গর্বের দিন উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর ছবি মুগ্ধ করেছে আমাদের। কাছে জীবনও ছবির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাঁর প্রেম কাহিনী হার মানবে রুপোলি পর্দার গল্পকে। প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে যেভাবে একজন নারী থাকেন, সেভাবেই পথের পাঁচালির সময় থেকে মানিকের ছায়াসঙ্গী ছিলেন বিজয়া। এমনকি নিজের সকল পাণ্ডুলিপি বিজয়াকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নিতেন সত্যজিৎ। সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হত না। এই বিজয়াকে পেতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি মানিককে। দীর্ঘ আটবছরের প্রেমের পর চুপিসারে বিবাহ সেরে দুই পরিবারের সম্মতি আদায় করেন সত্যজিৎ ও বিজয়া রায়।
প্রত্যেক দিন গান শোনার মধ্য দিয়ে একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানো শুরু করেন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া সত্যজিৎ ও বিজয়া। গত শতকের চল্লিশের দশকে বাঙালি সমাজে প্রেম করে বিয়ের ব্যাপারটা এতটা সহজ ছিল না। তার উপর ছিল আরও দুটো সমস্যা। বিজয়ার থেকে বয়সে বেশ ছোট হওয়ার পাশাপাশি দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন সত্যজিৎ ও বিজয়া। স্বভাবতই দুজনের বিয়ে কার্যত অসম্ভব ছিল। এরপরেই তারা কখনও বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন। এর মাঝেই মুম্বই চলে যান সত্যজিতের তৎকালীন প্রেমিকা বিজয়া রায়। এরপর আর থেকে আবেগ-প্রেমেই থেমে থাকেনি বিষয়টা, সে সময় প্রেমপত্র লেখার পাশাপাশি প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে বারবার মুম্বই যেতেন এই অস্কারজয়ী পরিচালক। মুম্বইতে গোপনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। সত্যজিৎ রায় জানতেন, পরিবার থেকে কেউ মেনে নেবে না এই সম্পর্ক। তাই স্থির করেছিলেন কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। যদিও বিজয়াদেবী জানিয়েছিলেন তাঁর মাকে, সেখান থেকে মেলেনি সম্মতি। তাই সবটা গোপন রেখেই বিয়ে পর্ব মিটিয়ে ফেলেন তাঁরা।
অবশেষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মানিক-বিজয়া। মুম্বইয়ের আদালতে নিজেদের সম্পর্ককে আইনত স্বীকৃতি দান করেন তাঁরা। ১৯৪৯ সালের ২০শে অক্টোবর বিজয়ার বোনের বাড়িতে গাঁটছড়া বাঁধেন মানিক-বিজয়া। বিয়ের ওই ছোট্ট অনুষ্ঠানেও সস্ত্রীক উপস্থিত হন বিখ্যাত অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুর। তারপর সবটাই চলতে থাকে গোপনে, সত্যজিৎ রায়ের মনে ছিল অন্য কাহিনী, নিজের মত করে এক গল্প লিখে চলেছিলেন তিনি। লুকিয়ে বিয়ে করার কারণে একসাথে থাকতে পারতেন না তাঁরা। এরপর একে-একে বড় কাজ, বড় সাফল্য আসে সত্যজিৎ রায়ের জীবনে। মুক্তি পায় অপু ট্রিলজি। অন্যদিকে বাড়ি থেকে ওঠে সত্যজিৎ রায়ের বিয়ে নিয়ে জল্পনা।
এসব খবর বেশি দিন চেপে রাখা যায় না! অবশেষে সকলের সামনে আসে বিজয়া-মানিকের বিয়ের কথা। জানা যায়, 'অপু ট্রিলজি' বিখ্যাত হওয়ার পরই বন্ধুবান্ধব ও পরিবারবর্গের কাছে নিজের বৈবাহিক সম্পর্কের কথা খোলসা করেন মানিক। সে সময় পাশে পান পারিবারিক বন্ধু নশো বাবুকে। নশো বাবুর বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই সত্যজিৎ তাঁর মাকে জানিয়ে দেন, যে বিজয়া রায় ছাড়া তিনি আর কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না। ছেলের বিয়ে দিতেই হবে...। এদিকে ছেলে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ে যদি করতেই হয় তবে তিনি বিয়ে করবেন বিজয়াকেই, নয়ত অবিবাহিতই থাকবেন। সব জল্পনার ইতি ঘটিয়ে, অবশেষে রাজি হয়ে যান সকলেই, কোনকিছুতেই কাজ না হওয়ায় অবশেষে সুপ্রভা দেবী সব মেনে নেন। তারপরই দ্বিতীয়বারের জন্য সত্যজিৎ রায়ের জীবনে বাজে বিয়ের সানাই। ১৯৪৯ সালের ৩রা মার্চ পুনরায় দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মানিক-বিজয়া।