কলেজের হলে বসেই তিনি ফেসবুক তৈরি করে ফেলেছিলেন। স্নাতকস্তরের পড়া শেষ হয়নি, দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ে তিনি তাঁর ওয়েবসাইটে পূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনিয়াসরাই বোধহয় ড্রপআউট হন, অন্তত পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলছে! বর্তমানে ফেসবুক বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি মার্কেটিং প্লাটফর্ম। জুকারবার্গের ফেসবুক প্রতিষ্ঠার কাহিনীকে নির্ভর করে ২০১০ সালে "দ্যি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক" ছবিটি নির্মিত হয়। যা আটটি বিভাগে অস্কার মনোনয়ন পেয়েছিল। ২০০৯ সালে লেখক বেন মেজরিচের "অ্যাক্সিডেন্টাল বিলিয়নেয়ারস" বইটি প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু কাল্পনিক অধ্যায়, কাল্পনিক চরিত্র, এবং ভাবনাপ্রসূত সংলাপের সমন্বয়ে লেখা বইটির জন্য মেজরিচ সমালোচিত হয়েছিলেন। তবে বইটির বিষয়বস্তু কতটা বাস্তবসম্মত এই বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। মেজরিচ তাঁর বইটির স্বত্ব চিত্রনাট্যকার অ্যারন সরকিনের কাছে বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। এই চিত্রনাট্যই পরবর্তীতে "দ্যি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক" সিনেমা হিসেবে মুক্তি পেয়েছিল।
১৯৮৪ সালের ১৪ই মে নিউ ইয়র্কের হোয়াইট প্লেইন্স-এর এক ইহুদি পরিবারে মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গের জন্ম হয়েছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি তাঁর বাবার সুবিধার জন্য বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের উপর ভিত্তি করে জুকনেট নামে একটি মেসেজিং সফটওয়্যার আবিষ্কার করেছিলেন যার ফলে রিসেপশনিস্টের সঙ্গে তাঁর বাবাকে আর চেঁচিয়ে কথাবার্তা বলতে হত না। বাবার চেম্বার ছাড়াও জুকনেট দিয়ে জুকারবার্গ তাঁর পরিবারের নিজেদের মধ্যে বাড়িতেও কথাবার্তা চালাতেন। শুধুমাত্র মজার ছলে বালক মার্ক তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটি কম্পিউটার গেমও তৈরি করেছিলেন। আসলে যে বয়সে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর প্রতি আকর্ষণ থাকে, সেই বয়সে মার্ক প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন।
মাইক্রোসফট এবং এ.ও.এল. উভয় কোম্পানিই মার্ককে তাদের সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু মার্ক প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাদের কোম্পানিতে চাকরি করতে না গিয়ে; হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০২ সালে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন CourseMatch নামক একটি প্রোগ্রাম তৈরি করেন যা ব্যবহারকারীদের ছাত্রদের পছন্দের উপর ভিত্তি করে ছাত্রদের মধ্যে গ্রুপ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে। এতে শিক্ষার্থীদের সুবিধা হত। এছাড়াও তিনি "Facemash" নামে আরও একটি প্রোগ্রাম সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন, যা ক্যাম্পাসের যেকোন দুইজন শিক্ষার্থীর ছবির মধ্যে তুলনা করত এবং এদের মধ্যে কে বেশি আকর্ষণীয় সেটা নির্বাচনের জন্য অন্য ব্যাবহারকারীরা ভোট দিতে পারত। প্রোগ্রামটি জনপ্রিয়তা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ক্যাম্পাসে এর ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।
এই সাইটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা নিজেদের কথাবার্তা ও বার্তা আদান প্রদান, নিজেদের ছবি ও তথ্য বিনিময় করার সুবিধা দেওয়ারও পরিকল্পনা করেছিলেন মার্ক। সাইটটির ডিজাইন করতে মার্ক হার্ভার্ড স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ককে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাভার্ড এলিটদের ক্যাজুয়াল ডেটিংয়ের সুবিধা করে দেওয়া।
এই সময়ে তিনি তাঁর তিন বন্ধু ডাসটিন মস্কোভিজ, ক্রিস হাগ্স এবং এদুয়ার্দো স্যাভেরিনকে নিয়ে নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। জুকারবার্গ এবং তাঁর বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তৈরি হওয়া নতুন এই সাইটটি, ব্যবহারকারীদের নিজস্ব প্রোফাইল তৈরি, ছবি আপলোড এবং অন্য ব্যবহারকারীদের সাথে যোগাযোগের সুবিধা দিত। প্রাথমিক ভাবে "The Facebook" নামের সাইটটির ডেভলপমেন্টের কাজ তাঁরা ২০০৪ সাল পর্যন্ত হাভার্ডের একটি হোস্টেলের ঘরে বসেই করেছিলেন।
হাভার্ডের দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করেই মার্ক পড়াশুনা ছেড়ে দিলেন, কারণ ফেসবুকে পূর্ণ সময় দেওয়া। হাভার্ড ছাড়ার পরে, তিনি তাঁর কোম্পানীকে ক্যালিফোর্নিয়ার পাওলো আলটোতে স্থানান্তর করলেন। ২০০৪ সালের শেষে হতে না হতেই ফেসবুক অ্যাপ ব্যবহারকারী দাঁড়ালো ১০ লক্ষ। ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল যে এইটিই হতে যাচ্ছে আগামী দিনের জয়েন্ট! হলও তাই!
২০০৫ সালে এসেল পার্টনার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ফেসবুকে বিনিয়োগ করল। টাকার পরিমান ছিল প্রায় এক কোটি সাতাশ লক্ষ মার্কিন ডলার। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মার্ককে। তবে সব সময় পথটা মসৃন ছিলো না! ২০০৬ সালে জুকারবার্গকে প্রথমবারের জন্যে একটি বড় বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু সব জয় করে ২০০৭ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বিলিয়নেয়ার হন।
কিন্তু এই পুরো পথে তিনি পাশে পেয়েছেন প্রিসিলাকে, মার্কের যখন কিছুই ছিল না তখন থেকেই তাঁর পাশে ছায়া সঙ্গী হয়েছিলেন প্রিসিলা। অনুপ্রেরণা হয়ে জুগিয়েছেন সাহস। ভরসা আর বিশ্বাসে ভর করে মার্ক অসাধ্য সাধন করে ফেললেন। সাধারণ কয়েকজনের মধ্যের একটি অ্যাপ আজ পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল। অনেকেই বলেই মার্ক খুব লাজুক ছিলেন, হয়ত প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করার জন্যই তিনি এমন একটা অ্যাপের কথা ভেবেছিলেন। একই সঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন মার্ক ও প্রিসিলা। ২০০২-২০০৩ সালে তাদের আলাপ। তারও অনেক পরে প্রেম শুরু। মার্ক ফেসবুককে বড় করার জন্যে যখন কলেজ ছেড়ে অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়িয়ে দিলেন তখনও সঙ্গী প্রিসিলা।
সাফল্যের চূড়ান্ত শিখর ছুঁয়ে ২০১২ সালের ১৯ মে জুকারবার্গ তাঁর বান্ধবী প্রিসিলা চ্যানকে বিয়ে করেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে মার্ক ও প্রিসিলা তাঁদের প্রথম কন্যাসন্তান ম্যাক্সের জন্ম দেন। ম্যাক্সের জন্মের পর জুকারবার্গ পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য দুই মাসের পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি ও প্রিসিলা তাঁদের কন্যার উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন, সেই চিঠিতে তাঁরা লেখেন যে; তাঁদের অধীনস্ত ফেসবুকের মালিকানার ৯৯ শতাংশ তাঁরা সেবামূলক কাজে দান করে যাবেন। ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর মার্ক এবং তাঁর স্ত্রী "চ্যান- জুকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ" (সি জেড আই) তৈরি করেন। যা বিশ্বজুড়ে সেবামূলক কাজ করে চলেছে।