“ তাকে আমার ভালোবাসা জানিও। তার চিঠি হাতে পাওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত বারো’বার পড়লাম। প্রতিবার লাইনগুলো নতুন। কালো অক্ষরগুলো তারার আলোর মত ফুটে উঠছে। সেই আলোতেই ডুব দিচ্ছি।
আর কোনও নারীর চিঠি এমন মায়া জাগাতে পারে কী আমার জানা নেই। জেনি খুব অন্যরকম। সহজ, কিন্তু সাধারণ নয়।
তাকে তিন খণ্ড কবিতা পাঠিয়েছি। বিপন্নতা থেকে জন্ম নেওয়া কবিতার সংকলন। আমার ঘরছাড়া ভাবনাগুলো সেই আয়নায় মুখ দেখে। পংক্তিতে পংক্তিতে আবেগ পাঠাই। বহুদূরের তারে তার ঢেউ লেগে থাকে।
কী হচ্ছে, কী হবে’-এর দ্বন্দ্বকে সরিয়ে কথারা কবিতায় মুখ গুঁজতে চায়। কিন্তু, শব্দের অলংকার সহজ ভাবনাগুলোকে ছিঁড়ে দেয়। তবু অস্বীকার করতে পারিনা মুহূর্তগুলোকে। অক্ষরগুলো জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে।
কখনও- কখনও কবিতা কিংবা শিল্পের থেকে অনেক বেশি কাছের মনে হয় জেনিকে...।”
১০.১১.১৮৩৭
বার্লিন
বার্লিনের এক তুষাররাতে বাবাকে এই চিঠি লিখেছেন ছেলে কার্ল মার্ক্স। বাবা হেনরিক মার্ক্স। বাবা-ছেলের নিতান্ত ব্যক্তিগত চিঠিতে উঠে এসেছে কার্লের ফিঁয়াসে’র কথা। প্রবাসী জীবনে তার ঘরে ফেরার টান। ভালোবাসার নোঙর।
কে এই জেনি?
জানতে হলে যেতে হবে জার্মানির এক শহরে। ট্রায়ার তার নাম। সেখানেই অভিজাত পরিবারে জন্ম জেনির।পুরো নাম জেনি ফন ওয়েস্টভ্যালেনের। মেধার ধারের সঙ্গে ধারালো সুন্দরী। মগজ-মনে নজরকাড়া।
রাইন নদীর নিম্ন অববাহিকায় ছোট্ট এই শহরটাতেই প্রথম দেখা কার্ল আর জেনির। শহরের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আর পাঁচটা গল্পের মতই ছিল তাদের গল্পটাও।
কেউ কারোর অচেনা নয়। দুজনের পরিবারই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ। ছোট্টবেলার কাঁচামিঠে বন্ধুতা। টক্কর দেওয়া ছাত্র-ছাত্রী।
বয়স বাড়তে ছোটবেলার খুনসুটি বদলে গেল ইংরাজি সাহিত্য আর দর্শনের আলাপে।
বয়ঃসন্ধি পেরিয়ে সেই বন্ধুত্ব আরক্ত হল ভালোবাসায়। খেয়াল রাখেনি কেউ। জানাজানি যখন হল তখন প্রবল বাধা এল জেনির পরিবার থেকে।
সীমাহীন চাপ, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দুজনের ঝোড়ো দিন। এরই মধ্যে উচ্চ শিক্ষার জন্য বার্লিন পাড়ি দিলেন কার্ল।
প্রথম প্রথম এক একটা দিনকে যেন এক একটা বছর মনে হত জেনির। তারপর ‘মুর’এর চিঠি আসত। হিমঋতু পার হয়ে বসন্তের প্রথম রোদ। ভালোবাসায় মুড়ে গুচ্ছ গুচ্ছ শব্দ পাঠিয়েছে তার প্রবাসী প্রেমিক।
সাতটা বছর পার। বাকিটা পথ এক করতে ১৮৩৬-তে বাঁধলেন নিজেদের। আর তারও বছর সাতেক পর এক গ্রীষ্মে বিয়ে সারলেন ওঁরা। জেনি ২৯, আর কার্ল ২৫।
দীর্ঘ মধুচন্দ্রিমায় ৪৫টা বই উপহার দিয়েছিলেন জেনিকে।
পরের সময় বড় উত্তাল। আঁধি ঝড়ে লাট খাওয়া জীবন।
জার্মানি ছাড়তে হল ওঁদের। চলে আসা নয়, এসকেপ। না হলে প্রাণ সংশয়।
গর্ভবতী জেনিকে নিয়ে কার্ল আশ্রয় নিলেন ছবি-কবিতার দেশে। প্যারিসে।
বাকি দুনিয়ার মত টালমাটাল ফ্রান্সও। শিল্পবিপ্লবের আঁচড়ে শান্তি উধাও।
দুজনেই প্রখর বাস্তবে। আন্দাজ ছিল অনাগত ভবিষ্যতের। জানতেন, গোরু খোঁজার মত করে খুঁজছে জার্মান সরকার। ছেড়ে কথা বলবে না ফ্রান্সও। কিন্তু তাদের খবর কাগজে আসার আগে পর্যন্ত কিছুটা আত্মগোপনের সুযোগ পাওয়া যাবে।
এর মধ্যেই মা হয়েছেন জেনি। আর্থিক চাপ চূড়ান্ত। কার্ল যোগ দিলেন ঈক্তি প্রগতিশীল সংবাদপত্রের সম্পাদক পদে।
কিন্তু শান্তি সহজ নয়।
ফ্রান্স জোড়া শ্রমিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগল জেনি আর কার্লের সংসারেও। ফের আন্দোলনে কার্ল। এদিকে ছেলে চার্লসের অসুখ দিনদিন বাড়ছে। পেটজ্বলা খিদেতে রাত ঘুমহীন। দিশেহারা জেনি। মারা গেল চার্লস। তাদের প্রথম সন্তান।
জেনির চোখে জল নেই। কার্ল-এর হাতখানা শক্ত করে ধরে।
বাস্তিলের পতন সম্পূর্ণ। কিন্তু দাবী যে অধরা। আবার রাস্তায় কার্ল। এত দিন তার চেতনায় বেড়ে ওঠা ভ্রূণকে জন্ম দিলেন। ১৮৬৪ সালে তৈরি হল প্যারি কমিউন।