১০৮ কোকনাদের রহস্য

"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর। ধরণীর বর্হিকাশে অন্তরীত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোর্তিময়ী।"

প্রকৃতিও বরণডালা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে দেবীর আরাধনার জন্য। বাঙালি মন এই সময় উড়ু উড়ু। দীর্ঘ অপেক্ষার  অবসান। দুর্গা শুধু দেবী নন, সে যে উমা, বাড়ির মেয়ে। তাই বাপের বাড়িতে মেয়ে আসার তোড়জোড় তো হবেই।

বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গা পুজার উল্লেখ নেই। পুরাণ এবং কৃত্তিবাসী রামায়নে দুর্গা পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। রামপ্রসাদের হাত ধরে সে উমা, বাড়ির মেয়ে। দুই কন্যা আর পুত্রকে নিয়ে চারদিনের জন্য বাপের বাড়িতে আগমন।

রাবণকে বধ করার জন্য দেবীর আরাধনা করা হয় বলে উল্লেখ রয়েছে। অকালে নিদ্রাভঙ্গ করে রামচন্দ্র দুর্গার পুজো করেছিলেন। রাবণ ও তাঁর লঙ্কাপুরী ভদ্রকালীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে সুরক্ষিত ছিল। রাবণকে ধ্বংস করতে হলে, দেবী ভদ্রকালীর সুরক্ষা থেকে রাবণকে বের করে আনতে হবে। তাই রাম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।  দেবী কিছুতেই সন্তুষ্ট না হওয়ায়, বিভীষণ রামকে একটি পরামর্শ দেন। ১০৮ নীল পদ্ম দিয়ে দেবীকে পুজো করার কথা বলেন।

রামের আদেশে হনুমান দেবীদহে যান। সেখানেই একমাত্র নীল পদ্ম পাওয়া যায়। পদ্ম আনার পর পুজো করতে করতে রাম দেখেন একটি পদ্ম কম আছে। তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। রাম নিজ পদ্ম সদৃশ চোখ দেবীকে দান করতে উদ্যত হন।  দেবী প্রসন্ন হয়ে আবির্ভূত হন এবং  বর দেন যে তিনি রাবণের থেকে নিজ সুরক্ষা সরিয়ে নেবেন। রাম পুজো শুরু করেন ষষ্ঠীতে, দেবী অষ্টমী ও নবমী তিথির মাঝে রামের অস্ত্রে প্রবেশ করেন। দশমীর দিন রাবণের বধ হয়।  কার্যসিদ্ধি করতে সহায়তা করে পদ্মফুল।

সন্ধিপুজো। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট, মোট ৪৮ মিনিট হল সন্ধিক্ষণ। পুরাণ মতে দেবী দুর্গা যখন মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে রত তখন তাঁর দুই সেনা চন্ড ও মুন্ড দেবীকে আক্রমণ করেন। দেবী দুর্গার তৃতীয় নয়ন থেকে এক দেবীর আবির্ভাব হয় যিনি চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেন।  দেবীর নাম হয় চামুন্ডা।

"নীলোৎপলদলশ্যামা চতুর্বাহুসমন্বিতা।

খট্বাঙ্গং চন্দ্রহাসঞ্চ বিভ্রতী দক্ষিণে করে।।

বামে চর্ম চ পাশঞ্চ ঊর্ধ্বাধোভাগতঃ বরাম্।।

কৃশাঙ্গী দীর্ঘ দংষ্ট্রা চাতিদীর্ঘাতিভীষণা"।

দেবীর চার হাত। তিনি নীলপদ্মের পাপড়ির মতো শ্যামবর্ণা। তাঁর ডান হাতে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস। বাঁহাতে ঢাল ও রজ্জুর অস্ত্র। গলায় মুন্ডমালা, পরিধানে বাঘের চামড়া। কৃষ্ণাঙ্গী, দীর্ঘাঙ্গী ও অতি ভীষণা। সন্ধিপুজোয়  দেবী চামুণ্ডারই পূজা হয় ১০৮ পদ্ম ও ১০৮ প্রদীপ জ্বালিয়ে।

কালিকাপুরাণে রয়েছে- " যে ব্যক্তি ভক্তিযুক্ত হয়ে ১০৮টি রক্তপদ্ম মহাদেবীকে অর্পন করে, সে মদীয় ধামে অসংখ্য কল্পবাস করে এবং শেষে পৃথিবীতে রাজা হয়ে জন্মগ্রহন করে"। পাঁকে জন্ম নিয়েও পদ্ম নির্মল। তার সৌন্দর্য ও সুবাস অমলিন। জন্ম যেখানেই হোক কর্মই আসল পরিচয়। খারাপ জায়গায় জন্মেও ভালো কাজ করে নিজের দৃষ্টান্ত তৈরি করা যায়। পদ্মফুল সেই বার্তাই দেয়। সন্ধিপুজোয় ১০৮ পদ্ম কেন লাগে? কেন কম বা বেশি নয়? হিন্দু শাস্ত্র মতে ১০৮ সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু দেবতার থাকে অষ্টোত্তর শতনাম। ১০৮ পদ্ম, ১০৮ প্রদীপ। যোগের ক্ষেত্রেও ১০৮ সংখ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আয়ুর্বেদ মতে আমাদের শরীরে ১০৮ টি "পয়েন্ট" আছে।  হিন্দুশাস্ত্র যন্ত্রের পূজায় বিশ্বাস করে। শ্রী চক্র যন্ত্রে ৫৪টি  করে কোন পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন হিসাবে দেখা হয়, যার থেকে সৃষ্টি, অর্থাৎ এখানেও ১০৮।

পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, মেচেদা এবং পাঁশকুড়াতে পদ্মফুলের চাষ করা হয়। এছাড়া বীরভূম ও দুই দিনাজপুরের চাষিরাও পদ্মফুলের চাষ করেন। পূর্ব মেদিনীপুরের ঝিল ও মেদিনীপুরের খালে সব থেকে বেশি পদ্ম চাষ হয়। বীরভূমের বড়ো বড়ো জলাশয়ে বর্তমানে চাষ শুরু হয়েছে। তবে কোলাঘাটের ছাই ও নানাভাবে দূষণের ফলে পদ্মফুলের পরিমাণ ও মান দুই কমতে বসেছে। পুজোর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এই ফুল হিমঘরে রাখা হচ্ছে। সারা বছর ফুলের যা প্রয়োজন হয়, তার থেকে কয়েক গুণ পদ্ম দরকার হয় দুর্গার সন্ধি পুজোর সময়। পাশের রাজ্য ওড়িশাও ফুলের যোগান দেয়। তবে গুণগত বিচারে বাংলার তুলনায় নিকৃষ্ট। সন্ধির সময় লক্ষ লক্ষ পদ্মফুল দরকার হয়। পদ্মফুল ছাড়া দেবীর পূজা অসম্পূর্ণ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...