একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আজকের প্রজন্ম কলকাতাকে যেভাবে দেখছে তাদের পূর্ব ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিন্তু সেভাবে দেখেন নি এবং দেখবেও না। কারণ আধুনিকীকরণের ও বিশ্বায়নের যুগে কলকাতাও তার চরিত্র ক্রমাগত পরিবর্তন করে চলেছে - আর সেটাই স্বাভাবিক, সময়ের সাথে টিকে থাকতে গেলে অভিযোজন তো প্রয়োজন। আর এই পদ্ধতির ফলেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যশালী ল্যান্ডমার্কগুলো । আজ বলবো কলকাতা জুড়ে থাকা বন্ধ হয়ে যাওয়া সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল ও থিয়েটার হলগুলোর কথা। মাল্টিপ্লেক্স এর আগমনের পরে এই সব হলের শেষ আশা ছিল কলেজ পড়ুয়ার দল। এই স্মৃতি অল্পবিস্তর সবারই আছে। ওই খুচরো পয়সার ঝনঝনানির মধ্যে আছে নস্টালজিয়া -এ প্রজন্ম তা আর শুনলো কোথায়! যদিও তারাই ছিল ভরসা, কিন্তু তাতে অন্তত হলের আলো জ্বলতো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই ! লড়াইটা আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য, নস্টালজিয়া বনাম লক্ষ্যে পৌঁছনোর দৌড়। আর এই গতির দৌড়ে গতি রুদ্ধ হয়েছে একাধিক সিনেমা হলের। যারা এখনো কোনোক্রমে টিকে আছে তাদের অবস্থাও রয়েছে ভেন্টিলেশন পর্যায়ে। মাল্টিপ্লেক্স, নেটফ্লিক্স , হটস্টারের যুগে লাইন এ দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার সময় কোথায়? হয় অনলাইন না হলে বাড়ি বসেই সিনেমা দেখা গেলে এই হলের প্রয়োজন কি ?
কিন্তু আগে তো আর এসব ছিল না। সমগ্র কলকাতা জুড়ে মানুষের সিনেমা প্রীতি থাকলেও উত্তর কলকাতা ছিল এব্যাপারে খানিকটা এগিয়ে। উত্তর কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চল একসময়ে বিখ্যাত ছিল তার সিনেমা আর থিয়েটারের জন্য। এই এলাকার থিয়েটারগুলো বিশ্বরূপা, সরকারিনা, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার বেশিরভাগই ছিল রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটের উপর- আর সিনেমাহলগুলো ছিল ঠিক বিপরীতেই । শুধু পূর্ণশ্রী বাদে সব ছিল বড় রাস্তার উপরে। ছিল রূপবাণী, রাধা, উত্তরা, শ্রী, মিত্রা, মিনার, দর্পনা । রংমহল, ষ্টার থিয়েটার ছিল কর্নওয়ালিস স্ট্রিট বা বর্তমানের বিধান সরণির উপর। যদিও ষ্টার থিয়েটার রাজ্য সরকারের সহায়তায় নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে আধুনিকতার মোডকে। রূপবাণী, রংমহল ভেঙে শপিং মল আর ফ্ল্যাট হয়েছে - তবে স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে ফলক রেখে দেওয়া হয়েছে। রূপবানীর একটা ঐতিহ্য ছিল, কারণ ১৯৩২ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর উদ্বোধন করেছিলেন। একের পর এক সিনেমা হল - প্রত্যেকটিই চলতো রমরমিয়ে। এদের মধ্যেই অনেকগুলোই ছিল উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ কলকাতা সিনেমার চেইনের অন্তর্গত যেমন রূপবাণী, অরুণা, ভারতী , রাধা, পূর্ণ, উত্তরা- উজ্জ্বলা - পূরবী, শ্রী-প্রাচী-ইন্দিরা,মিনার-বিজলি- ছবিঘর। নতুন সিনেমা এলে এই হলগুলোতে একসাথে রিলিজ করতো। সেটাই নিয়ম ছিল। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে আর শনি ও রবিবার বিকেল ও সন্ধ্যে বেলায় ভীড় উপচে পড়তো কারণ থিয়েটারের শো’গুলো হতো মূলত সেই সময়, যদিও সিনেমার শো প্রত্যেকদিনই ৩ টে করে থাকতো। এখানে বলে নেওয়া ভালো সেগুলো সবই কিন্তু সিঙ্গল স্ক্রিনের ছিল। অর্থাৎ সেখানে একটাই সিনেমা চলতো। এখনকার মতো একাধিক সিনেমার অপশন ছিল না।
শুক্রবার নতুন কোনো ছবি রিলিজ করলে বুধবার অ্যাডভান্স টিকেটের জন্য লম্বা লাইন পড়তো। আর তা উত্তম সুচিত্রার বা উত্তম সুপ্রিয়া দেবীর হলে সেই প্রথম শো’এর জন্য আগ্রহী মানুষের ভিড় ছিল দেখার মতো। মাঝে মাঝে সেই ভিড় সামলাতে হতো পুলিশকে। কিন্তু সে সব আজ ইতিহাস। সেসব জায়গায় এখনো ভিড় হয়, তবে শপিং মলের কেনা কাটার ভিড়। আজ এই ব্যস্ততম সময়ে আরামে সিনেমা দেখা, রাতে দস্তুর মতো বিলিতি কায়দায় ডিনার এসব তো আর আগে সম্ভব ছিল না। কিন্তু বলতেই হয় বাড়ির মহিলারা রাতের শো দেখতে গেলেও নিরাপদ ছিল সে কলকাতার রাত। বলতে দ্বিধা নেই আজকের উদ্দাম কলকাতার মাঝ রাতের নিস্তব্ধতায় কেমন এক নিরাপত্তাহীনতার শব্দ শোনা যায়। তা সে প্রযুক্তিগত ভাবে আপনি যতই উন্নত হোন না কেন, আপনার সাফল্য, স্বাচ্ছন্দ্য যাই আসুক না কেন এই প্রশ্ন কিন্তু আপনার মনের অগোচরে থাকবেই।
এই হলগুলো কিন্তু ছিল কিছু পরিবারের পরিচায়ক। কিছু কিছু নাম তার পরিচয়বাহী। যেমন মিনার-বিজলি-ছবিঘর ছিল হল মালিক হরিপ্রিয় পালের তিন মেয়ের নামে । মিত্রা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে , তখন নাম ছিল চিত্রা। কিন্তু ১৯৬৩ সালে হেমন্তকৃষ্ণ মিত্র এর মালিকানা ক্রয় করলে এর নাম হয় মিত্রা। প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে এই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম ওকালতির সাথে যুক্ত থাকায়, তাদের ল-ইয়ার্স চেম্বার ছিল এই হলের দোতলায়। যদিও অতি সম্প্রতি মিত্রার গতি স্তব্ধ হয়েছে। তার অবস্থা কিন্তু চরম শোচনীয় ছিল না। ২০১৯ এপ্রিল এর থেকে বন্ধ হয়েছে , কিন্তু বাড়িটি একই রকম আছে। এর মধ্যেই রূপবাণী, শ্রী, উত্তরা বহুদিন বন্ধ হয়ে সেখানে একাধিক দোকান, ফ্ল্যাট হয়েছে। তবে বাস স্টপ হিসেবে নামগুলো আজও দিনের মধ্যে কতবার যে উচ্চারিত হয় তা বলা বাহুল্য। যারা সেকালের মানুষ, একটু আগের প্রজন্মের যারা এই সবের প্রাণবন্ত অস্তিত্ব থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের কাছে এই কলকাতা কিছুটা ভিন্নভাবেই ধরা দিয়েছে।
যাই হোক আপামর বাঙালির সাথে উত্তম -সুচিত্রা, ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী ,ছায়া দেবীসহ একাধিক মহিরূহদের পরিচয় ঘটিয়েছিল এই সিনেমা হলগুলোই। এছাড়া বিখ্যাত পরিচালকদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো এই সব হল থেকেই। আবার এই সিনেমার মহীরুহরদের দর্শকদের কাছে সরাসরি পৌঁছনোর মাধ্যম ছিল থিয়েটার হল গুলো। ছায়া দেবী, ছবি বিশ্বাস, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথেশ বড়ুয়া কার কথা বাদ দেব- এনারা সকলেই প্রতিনিয়ত নাটক করতেন। আবার অনেকের উত্থান সেই নাটক থেকেই। বাংলা সিনেমার সাথে এই সব নামগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আবার তাদের অনেকেরই বিদেশী সিনেমাগুলোর প্রতি আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কিন্তু এই প্রেক্ষাগৃহগুলোই। যার অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এলিট, চ্যাপলিন। এলিট নামেই আছে আভিজাত্যের ছাপ। যদিও ১৯১৫ তে এর নাম ছিলো 'প্যালেস অফ ভ্যারাইটি', ১৯৩৮ এ নাম হয় এলিট। ইতালি থেকে আনা হয় প্রজেক্টর, ব্রিটেন থেকে প্রথমে আর্কিটেক্ট রিডলি এবোট, তার মৃত্যুর পর জন বার্কমান ফার্নান্দেজ এসে ডেকোরেশন সম্পূর্ণ করেন ১৯৪৮এ। তারপর 'রেড রিভার' দিয়ে যাত্রা শুরু হয় তার। ফক্স এর সাথে চুক্তি থাকায় প্রথমে ইংলিশ সিনেমা চলতো। পরে বাংলা , হিন্দি চালানো শুরু হয়। মৃনাল সেনের 'ভুবন সোম' এর প্রিমিয়ার হয় এখানেই। সত্যজিৎ রায় সহ একাধিক বিখ্যাত মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল এই হল।
চ্যাপলিন ভারতের প্রথম সিনেমা হল তাও আজ বন্ধ। এছাড়া গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, টাইগার, দঃ কলকাতার মালঞ্চ এসবই বন্ধ। তবে প্রাচী, টকি শো হাউস সহ আরো কিছু প্রায় বিলুপ্ত হল কতদিন সেই অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে সেটাই দেখার।