উল্টোরথের রশিতে জগন্নাথের পিছুটান

দেখতে দেখতে গুণ্ডিচায় ন’টা দিন কেমন করে জানি কেটে গেল। তা, জগন্নাথ এখানে এলেন কেন? উত্তর দিলেন দু'জন, হল দ্বিমত। সনাতনী বললেন, মাসির আদর খেতে; বোষ্টম বললেন, শ্রীরাধিকার সান্নিধ্য পেতে। সে আদর খাওয়াই হোক বা প্রেম-সান্নিধ্যই হোক--সময়টুকু যেন লহমায় কেটে গেল। কিন্তু, এতে কি মন ভরে? মন না-ভরলেও পড়ে আছে পিছুটান। ফিরে আসার টান। ‘উল্টোরথ’-কথাটার তাৎপর্যই এখানে। আসলে, জগন্নাথের এই যে গুণ্ডিচায় যাওয়া, এ-কিন্তু আত্মসুখের জন্য যাওয়া। তবুও, সেখানে তাঁর কৃপাময়রূপটিই আমরা দেখতে পাই। কারণ, তিনি সেখানে গিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষারত মাসিকে স্নেহরসে আপ্লুত হতে দিয়ে কৃপা করেন কিম্বা অনন্ত অপেক্ষায় থাকা শ্রীরাধাকে প্রেমের পরশ দিয়ে কৃপা করেন। শেষ পর্যন্ত কিন্তু জগতের নাথের আত্মসুখে মগ্ন হলে চলে না, তাঁকে অবিরত ডাক দেয় জগতসুখ। সেই সুখদানের মধ্য দিয়েই ঘটে তাঁর পরম কৃপাময় রূপের প্রকাশ। তাই নিজের সুখ উপেক্ষা করে ভক্তকুলকে তিনি সেই সুখে সুখী করতে এগিয়ে আসেন। আর এই দর্শনের জন্যই কৃপাময়কে নিজের আসনে ফিরিয়ে আনতে বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়ির ছোট্ট রথটি অলিন্দ পথ দিয়ে একদা উল্টোরথের দিন টেনেছিলেন রামকৃষ্ণদেব।

উল্টোরথের দিন গুণ্ডিচা থেকে ফেরার পথে পুরীর মন্দিরের স্বর্গদ্বারের সামনে এসে থামে জগন্নাথের রথ। তখন তাঁর আদুল গা। গায়ে চন্দনী সুবাস। সেই সুবাস ভক্তকুলের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেবার জন্যই যেন তাঁর অপেক্ষা। কারণ, এই ক্ষণটিতেই জাতিবর্ণধর্ম নির্বিশেষে রথে উঠে প্রাণের ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরার, একান্ত করে অবলোকন করার, তাঁর দেহের সুবাস গায়ে মাখার সৌভাগ্য লাভ করেন ভক্তেরা। এখানে সর্বজনের স্পর্শ নিয়ে, সকলকে স্পর্শ দিয়ে তবেই জগন্নাথ রাজবেশ ধারণ করেন, ছেড়ে যাওয়া রত্নবেদীর আসন গ্রহণ করেন। এই প্রথার মধ্য দিয়ে ঠাকুর যেন বলতে চান : ক’দিন নিজেকে নিয়ে ছিলাম বটে, তবু তোমাদেরই ছিলাম, তোমাদের আছি, তোমাদের জন্যই ফিরে এসেছি! তোমাদের সঙ্গে আমার কোন অন্তর নেই, আছে শুধু অনন্ত অন্তর-লোকের যোগ।

সকলের সঙ্গে এই যে সকলকে মিলিয়ে দেওয়া আর সবার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া--এটাই জগন্নাথপূজার মর্মকথা। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছাও বটে। আর সেই ইপ্সার প্রকাশ পৌরাণিক আদি গাথার মধ্যেও দেখা যায়। কারণ, তাঁরই ইচ্ছেতে তিনি ব্যাধসমাজের কুলদেবতা হয়েছিলেন, তাঁরই ইচ্ছেতে ক্ষত্রিয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁকে বনের গুহা থেকে নগরের মন্দিরে এনে স্থাপন করেছিলেন। ব্যাধসমাজের কাছ থেকে জগন্নাথদেবকে ছলে আনতে গিয়ে ব্রাহ্মণ সন্তান বিয়ে করেছিল ব্যাধের মেয়েকে। এই যে তাঁর বন থেকে নগরের যাত্রাপথ--এই পথপরিক্রমার মধ্য দিয়েই তিনি একসূত্রে মিলিয়ে দিয়েছিলেন তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর ব্যাধেসমাজের সঙ্গে উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণসমাজকে এবং শাসকশ্রেণী ক্ষত্রিয়সমাজকে। তিনি মিলনের দেবতা। আসলে, জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সকলকে মিলিয়ে দিতেই তাঁর রথযাত্রা এবং উল্টোরথের লীলা। তিনি জানেন মন্দিরের বাইরের বিস্তীর্ণ যে পথ, সেখানেই সবাইকে মুক্ত আকাশের নীচে এক করে দেওয়া যায়। আর এই ঐক্যমন্ত্রেই লুকিয়ে আছে রথযাত্রার ‘যাত্রা’ আর উল্টোরথে ‘ফেরা’র মাহাত্ম্য। এ-যেন প্রিয়র কাছ থেকে প্রিয়তমের কাছে ‘যাত্রা’; প্রিয়তমের কাছ থেকে প্রাণপ্রিয়র কাছে ‘ফেরা’। এবং, এই যাতায়াতের পথে সর্বত্রই ধ্বনিত হয়--'তুমি'-'আমি' মিলে 'আমরা' হয়ে ওঠার মন্ত্র...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...