দক্ষিণাত্যের গোকর্ণপুরে 'গোকর্ণেশ' নামে শিবের বিখ্যাত এক লিঙ্গমূর্তি ছিল। সেই মূর্তির সর্বপাপনাশী মাহাত্ম্য শুনে স্বর্গ থেকে স্বয়ং নারদ এলেন একদিন দর্শন করতে। মন্দিরের প্রবেশ পথে একটি চাঁপা ফুলের গাছ। তাতে ফুটে আছে অপূর্ব সুন্দর ফুল। শোভা দেখে নারদ যেন বিভোর হলেন। তারপরই খেয়াল করলেন গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্রাহ্মণ। হাতে ফুলের সাজি। নারদ জিজ্ঞেস করলেন, 'ওহে ব্রাহ্মণ, তুমি কি চাঁপা ফুল তুলতে এসেছ?'
ব্রাহ্মণ যেন থতমত খেয়ে গেল। বলল, 'না না ঠাকুর, ফুল তুলতে কেন আসব, আমি ভাটভিখারি মানুষ, ভিক্ষেয় বেরিয়েছি!'
নারদ আর বাক্যটি না-বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। শিব-দর্শন ও প্রণাম করে মন্দির থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগোতেই আবার ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা। হাতের সাজিটি এখন পাতা দিয়ে ঢাকা, ভেতরে কি আছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তাই দেখে নারদের কৌতূহল হল। জিজ্ঞেস করলেন, 'সাজিতে কি রেখেছ, ব্রাহ্মণ?' ব্রাহ্মণ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, 'সাজিতে?...ওই.. সামান্য ভিক্ষে..!' নারদকে ছাড়িয়ে সে দ্রুত এগিয়ে গেল। লোকটার ভাবগতিক তো ভালো ঠেকছে না! কিছু একটা লুকোতে চাইছে! ব্যাপারটা কি?--এসব ভাবতে ভাবতেই নারদ হাজির হলেন চাঁপাগাছটির কাছে। দেখলেন, গাছে একটাও ফুল নেই, এক্কেবারে ন্যাড়া! জিজ্ঞেস করলেন, 'আহা রে, তোমার সমস্ত ফুলই কি ওই ব্রাহ্মণ তুলে নিয়ে গেল?' কিন্তু, চাঁপা যেন কিচ্ছুটি বোঝে না, আবোল-তাবোল বকতে লাগল, 'ফুল কি? ব্রাহ্মণ কে? তুমিই বা কে!' নারদ বুঝলেন কিছু একটা রহস্য নিশ্চয় আছে, সেটা না-জানা অব্দি তো স্বস্তি নেই!
নারদ আবার ফিরলেন মন্দিরে। কিন্তু, মন্দিরে ঢুকেই অবাক। ঠিক একশো আটটা চাঁপাফুলে কে যেন এইমাত্র মহাদেবকে পুজো করেই চলে গেছে! সম্ভবত, ব্রাহ্মণটা! সেইসময় মন্দিরের পূজারি এলেন পুজো করতে। তাঁকে নারদ জিজ্ঞেস করলেন, 'হে পূজারি, আপনি কি জানেন, এই একশো আটটি চাঁপাফুল দিয়ে কে পুজো করেছে মহাদেবকে?' পূজারি হেসে বললেন, 'তা আর জানি না! দুষ্ট ব্রাহ্মণটা সবাইকে লুকিয়ে, চাঁপাগাছকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে রোজ এভাবেই শিবের পুজো করে যায়। যাতে তার উদ্দেশ্য কেউ জানতে না-পারে!' অবাক নারদ জিজ্ঞেস করলেন, 'উদ্দেশ্য! কী তার উদ্দেশ্য?' পূজারি বললেন, 'তার একটাই উদ্দেশ্য, শিবকে তুষ্ট করে রাজাকে বশে রাখা--'
পূজারির কথা শেষ হল না। তার আগেই সেখানে কাঁদতে কাঁদতে আছাড় খেয়ে পড়ল এক বুড়ি বামনি। নারদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হয়েছে মা? কাঁদছ কেন?' তখন কাঁদতে কাঁদতে বুড়ি যা বলল, তা হল :
বুড়ি বামনির একটি মেয়ে আছে, বিয়ের যোগ্য হয়েছে। কিন্তু, মেয়ের বিয়ে দেবার সামর্থ্য নেই। একদিন সেই দুষ্ট ব্রাহ্মণটি বুড়োর কাছে ভালোমানুষের মতো এসে বলল, রাজা যাতে বিয়ের সব খরচ দেয়, তার ব্যবস্থা সে নিজে করে দেবে। তার কথায় বিশ্বাস করে বুড়োবুড়ি রাজবাড়িতে গেল। দেখল, রাজাকে ব্রাহ্মণ যেন বশ করে রেখেছে। তারই সুযোগ নিয়ে রাজভাণ্ডার থেকে নিজে অনেক ধনরত্ন তো নিলই, বুড়োবুড়িকেও যথেষ্ট ধন পাইয়ে দিল। ও মা, বাড়িতে ফিরেই ব্রাহ্মণ যেন চণ্ডরূপ ধারণ করলো! তারপর বুড়োবুড়িকে মেরেধরে সমস্তকিছু লুঠে নিয়ে চলে গেল! এখন বুড়োবুড়ির অবস্থা আরও খারাপ, তারা মেয়ের বিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, খাবে কী তারই ভাবনায় মরছে!
সব শুনে নারদের খুব রাগ হল। তিনি শিবকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে প্রভু, তুমি দুষ্ট ব্রাহ্মণকে দয়া করছ, অথচ অসহায় বুড়োবুড়ির দিকে তাকিয়েও দেখছ না!...এ তোমার কেমন বিচার, প্রভু?' তাঁর অভিযোগ শুনে শিব লজ্জিত হলেন। বললেন, 'কী করব বাপু, আমি যে চাঁপাফুল বড্ড ভালোবাসি। আর ওই ব্রাহ্মণ আমাকে নিত্য একশো আটটি চাঁপায় পুজো করে। এই ফুলে যে আমায় পুজো করে সে জগতশুদ্ধ সবাইকে বশ করতে পারে। তাই সে রাজাকেও বশ করতে পেরেছে, আমাকেও বশ করেছে।' নারদ বললেন, 'তাহলে এ-অন্যায়ের প্রতিবিধান?' শিব বললেন, 'তুমি আমার পরমভক্ত। তুমি যে প্রতিবিধান করবে, তাই হবে সত্য!' শিবের আদেশ পেয়েই মনের সমস্ত রাগ নিয়ে নারদ বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে। সেই দুষ্ট ব্রাহ্মণ তখন দূরে মন্দির ছাড়িয়ে রাজবাড়ির পথ ধরেছে। ভীষণ স্বরে নারদ হুঙ্কার দিয়ে তাকে থামালেন, 'ওরে দুষ্ট ব্রাহ্মণ, তুই মানব হয়ে জন্মেও অমানবিক অন্যায় করছিস, মিথ্যাচার করছিস; আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তুই এক্ষুনি ঘৃণ্য রাক্ষস হয়ে জন্ম নিবি!' তাকে শাপ দিয়েই রাগে কাঁপতে কাঁপতে নারদ হাজির হলেন চাঁপা গাছটির সামনে, অভিশাপ দিলেন তাকেও, 'ওরে দুর্মতি-মিথ্যাচারী তোর যে-ফুল মহাদেবের এত প্রিয়, যে-ফুলে পূজা করে জগৎ বশীভূত করার ক্ষমতা রাখত মানব; সেই ফুল আজ থেকে আর মহাদেব গ্রহণ করবেন না, সেই ফুলে পুজো দিলে আজ থেকে মানব মহাদেবের কৃপা নয়, লাভ করবে কেবল অমঙ্গলের রোষ!'-এই বলে নারদ দর্পের সঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গলোকের দিকে পাড়ি দিলেন।
এভাবেই মর্তে শিবের পুজোয় সেদিন থেকে চিরদিনের জন্য চাঁপা ফুল নিষিদ্ধ হয়ে গেল।
গল্পের উৎস : শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত, 'শিব পুরাণ'।