ঐতিহাসিক জেলা মেদিনীপুরের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধি, তেমনই এখানকার পৌরাণিক ইতিহাসও খুব প্রসিদ্ধ। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের আনন্দপুরে রয়েছে কানাশোল গ্রাম। এই কানাশোল গ্রামেই বিরাজ করেন ঝড়েশ্বর। মন্দিরের বয়স ৩৫০ বছরেরও বেশি। সাড়ে তিন শতকের প্রাচীন এই ঝড়েশ্বর শিব মন্দির। মন্দিরের পাশেই রয়েছে, ১৪ একরের বিশাল দিঘি। এই দিঘিতে ডুব দিয়েই ঘটে জল ভরে শিবের মাথায় ঢালেন ভক্তরা। দিঘিটি খনন করে দিয়েছিলেন রাজা আলালনাথ দেব। সেই কারণে এই দিঘি আলাল দিঘি নামেও পরিচিত।
আজ যেখানে এই মন্দির দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে ছিল জঙ্গল ও বটগাছ। সেখানেই মাটির নীচে ছিল শিবলিঙ্গটি। জনশ্রুতি রয়েছে, সেই শিবলিঙ্গের ওপর প্রতিদিন দুধ ঢেলে দিয়ে আসত একটি কৃষগাভী। সেই দৃশ্য দেখে ফেলে এক রাখাল বালক। সেদিন রাতেই স্বপ্ন দেখেন গাভীর মালিক, ব্রাহ্মণভূমের রাজা আলালনাথ দেব ও আড়িয়াদহের পুরোহিত শীতলানন্দ মিশ্র। কৃষ্ণগাভীটি যে জায়গায় দুধ দিত, সেখানেই মাটি খুঁড়ে শিবলিঙ্গ উদ্ধার হয়। ১৬২৯ সালে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে এই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাম দেওয়া হয় ঝড়েশ্বর শিব। ভক্তদের বিশ্বাস, এই মন্দিরে শিবের ব্রত পালন করলে কঠিন রোগ থেকে মুক্তি মেলে। সন্তানহীনা মায়ের কোলে সন্তান আসে। বিপুল সংখ্যক ভক্তরা ঝড়েশ্বর শিবের মাথায় জল ঢালতে আসেন।
মন্দিরের উচ্চতা ৬৭ ফুট। এই মন্দির চারবার সংস্কার করা হয়। ১৮৩৪ প্রথমবার সংস্কার করা হয়েছিল। তারপর ১৯৩০, ১৯৬০ ও ১৯৯৯ সালে বার কয়েক মন্দির সংস্কার করা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৮৩৪ সালে নাড়াজোলের রাজা অযোধ্যারাম খাঁয়ের দেওয়ান রামনারায়ণ জানা ঝড়েশ্বর দেবের কাছে মানত করেছিলেন। তারপরই তিনি কঠিন রোগ থেকে সেরে ওঠেন, এরপরই মন্দিরের খ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আজ কয়েকটি শিব মন্দিরের কথা বলব। বঙ্গে অজস্র জোড়া শিব রয়েছেন, উত্তর কলকাতার মসজিদবাড়ি অঞ্চলে রয়েছে জোড়া শিবমন্দির। দু-পাশে দুই মন্দির, মধ্যিখানে ছোট্ট একটি গলি। প্রচলিত ইতিহাস বলে, ১১৪০ বঙ্গাব্দ নাগাদ জনৈক সাতকড়ি শেঠ মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। আজও এখানে নিয়মিত পুজো হয়। মন্দির দুটি আটচালা স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত। খিদিরপুর এলাকায় রয়েছে এক যমজ মন্দির। এখানে প্রায় ১৮ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ বিরাজ করেন। শিব এখানে, কৃষ্ণ চন্দ্রেশ্বর এবং রক্ত কমলেশ্বর নামে পরিচিত। কথিত আছে, সাধক রামপ্রসাদ এই মন্দির দেখতে এসে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন কৈলাশ থেকে শিব স্বয়ং নেমে এসেছেন।
আবার কোথাও কোথাও মায়ের নামেই পরিচিত হয়েছেন শিব। উত্তর কলকাতায় বিডন স্ট্রিট দিয়ে গঙ্গা বা নিমতলা শ্মশানে যাওয়ার পথে মহম্মদ রমজান লেনে রয়েছে এক বিশাল শিবমন্দির। শিব এখানে দুর্গেশ্বর শিব মন্দির বা মোটা মহাদেব নামে পরিচিত।
১৭৯৪ সালে রসিকলাল দত্ত ও জহরলাল দত্ত এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। নদীয়ায় রয়েছেন ভবতারণ। ১৮২৫ সাল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধর নদীয়া-রাজ গিরিশচন্দ্র রায় ভবতারণ ও ভবতারিণীর বিগ্রহ স্থাপন করে পোড়া মা থানে পাশাপাশি দুটি রত্নমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ভবতারণ যা এক বিশাল শিবলিঙ্গ। নদীয়ার রাজা রুদ্র রায় নবদ্বীপে গঙ্গাতীরে এক বিশাল শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে রয়েছেন রাঘবেশ্বর। গঙ্গার ভাঙন থেকে শিবলিঙ্গটিকে রক্ষা করার জন্য গঙ্গাতীরবর্তী একটি স্থানে পুঁতে রাখা হয়। রাজা গিরিশচন্দ্র পোড়া-মা তলার পাশে রত্ন-মন্দিরে ভবতারণ নাম দিয়ে এই শিবলিঙ্গটিকে প্রতিষ্ঠা করেন।