শিবের গাজন কোন পৌরাণিক পার্বন নয়। আঠের পুরাণের কোনটিতেই গাজন উৎসব উদযাপন বা পালনের কথা নেই। এটি অনেক পরবর্তীকালের ব্যাপার। তবে একেবারেই নবীন নয়, নয় নয় তার বয়স হল বৈকি পাঁচ-ছ'শো বছর।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, শিবের গাজন পৌরাণিক নয়; কিছুটা লৌকিক, বাকিটা ধার করা। ধার করা অবশ্য বঙ্গসংস্কৃতি থেকেই। কীভাবে এবং কোথা থেকে সেটাই আজ বলব :
ব্রাহ্মণশ্রেণি পণ্ডিত-পুরোহিতের ফাঁদে পড়ে একদা বহু বহু কাল ধরে হাঁড়ি-ডোম-বাগদি-বাউরি-লোহার প্রভৃতি জাতির হিন্দুদের অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ও জল-অচল ঠাউরে অত্যন্ত অন্যায় করেছিল। শোষণ করে চলেছিল। অনুষ্ঠানে অপাংক্তেয় করেছিল, উচ্ছিষ্টমাত্র খেতে বাধ্য করেছিল। নিতান্ত দরিদ্র ও স্ববশ করে রেখেছিল। আর ক্ষত্রিয় তার এই অন্যায়ে বরাবর দোসরের ভূমিকা পালন করে চলেছিল।
এই বৈষম্য বজায় ছিল পুজা-পার্বনের ক্ষেত্রেও। ফলে, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের এই দুর্ব্যবহারে হিন্দু মান্য-দেবতাদেরও নিজেদের দেবতা বলে মানতে অসুবিধে হচ্ছিল ওইসব তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির মানুষের। তাঁরা নিজেদের এমন একটি দেবতার খোঁজ করতে লাগলেন, যাঁর পুজো তাঁরা নিজেরা করতে পারবেন, কোন ব্রাহ্মণের দরকার পড়বে না, ঠাকুরের আবাস গড়তে কোন ক্ষত্রিয়ের ঠাকুর দালানের দরকার পড়বে না, মন্দিরের প্রয়োজন হবে না এবং ঠাকুরের থানে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে উঠতে হবে না, কারও বাধা মানতে হবে না।
ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে তাঁরা পেলেন এক অবহেলিত ঠাকুর, উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যাঁকে কালক্রমে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ধর্ম ঠাকুরকে।
ধর্ম ঠাকুরের উদ্ভব ইতিহাসের ঠিক কোন পর্বে জানা যায় না। তবে তা যে বেশ প্রাচীন, এটা বলা যায়। বৌদ্ধ ধর্ম যখন প্রবল হয়ে হিন্দু ধর্মকে গ্রাস করছিল, যখন সে হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীদের নিজের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করছিল, তখন সূর্য-বরুণ-বিষ্ণু-যমের সম্মিলনে গড়ে ওঠা 'ধর্ম ঠাকুর'ও তার মধ্যে ছিলেন।
তারপর কয়েকশো বছর পর আবার যখন হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ঘটল, তখন আর-সব দেবদেবী নিজের নিজের কৌলিন্য ফিরে পেলেও, আশ্চর্যরকমভাবে ধর্ম ঠাকুর কিন্তু বাতিল হয়ে গেলেন।
তারপর বহু যুগ কেটে গেল। আজ থেকে সাত-আটশো বছর আগে তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির হাত ধরে ধর্ম ঠাকুরের পুনরুত্থান ঘটল। ধর্ম ঠাকুর কোথাও মাটির হাতিঘোড়ার প্রতীকে বহুবর্ষজীবী কোন গাছের তলায় (এরা আসলে ধর্ম ঠাকুরের বাহন হিসেবে কল্পিত); কোথাও বা কচ্ছপের পিঠের মতো কোন পাথরের প্রতীকে পূজিত হতে লাগলেন।
ক্রমে ক্রমে শুরু হল বছরে একবার বিশেষ পুজোর আয়োজন। সেই পুজোয় ব্রতী হতে শুরু করলেন অসংখ্য ভক্ত। তাঁদের 'জয় জয় নিরঞ্জন', 'ধর্ম জয়', 'জয় জয় ধর্ম' বলে সজোর-গর্জনে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে শুরু করল। এই 'গর্জন' থেকেই লোকমুখে এই বিশেষ পুজোর নাম হয়ে গেল, 'গাজন'।
কালক্রমে গাজনের সমারোহ বাড়ল।
সমারোহ এমন বাড়ল যে, তা আত্মনির্যাতনের আকর হয়ে উঠল। পুজোর আবশ্যিক সঙ্গী হয়ে উঠল। নিয়ম তৈরি হয়ে গেল। এই আত্মনির্যাতনের একটি জাদুমূলক দিক আছে। সেটাই এবার বলছি :
লোকসংস্কৃতিতে 'জাদু' বলতে বোঝায়, ধরুন, আমি যদি মানত করে ঠাকুরথানে মন্ত্র পড়ে বা ব্রত হিসেবে একটি মুরগি বলি দিই, তাহলে সেই মুরগির প্রাণ আমার সন্তানের প্রাণশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার আয়ু বাড়াবে--এরকম।
আগেই বলেছি, ধর্ম ঠাকুরের রূপ-ভাবনায় কয়েকজন দেবতার সঙ্গে যুক্ত আছেন যমও। যম হলেন মৃত্যুর দেবতা ও মৃত্যুপরবর্তী বিচার-বিভাগের কর্তা। পাপ বুঝে তিনি নরকের শাস্তি বিধান করেন। তাই তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির মানুষ ভাবলেন যে, যম অর্থাৎ ধর্মের কাছে যদি তাঁরা নিজেকে নিজেই শাস্তি দেন, তাহলে পরলোকে তাঁর আর কঠোর-কঠিন শাস্তি হবে না। সেখানে নিশ্চিন্তে স্বর্গসুখ ভোগ করতে পারবেন, কারণ, এখানেই তো তাঁরা শাস্তি মাথা পেতে নিচ্ছেন! তার জন্য নিশ্চয়ই পুণ্যটুকু জমা হচ্ছে চিত্রগুপ্তের খাতায়!
ভাবনার ওই স্তর থেকেই বাণফোঁড়া, আগুন খোলা মাথায় নেওয়া, আগুনে হাঁটা, কাঁটায় হাঁটা, দন্ডী দেওয়া, আহারে-বিহারে-বসনে কৃচ্ছ্রসাধনা, সন্ন্যাস ব্রত পালনের মতো আত্মনির্যাতনের প্রক্রিয়াগুলো অবলম্বন করা হতে লাগল। সে যা হতে লাগল, তেমনটা আর কোন ধর্মাচারে দেখা যেত না। অন্যগুলোতে ভোগ ছিল, জাঁকজমক ছিল, আড়ম্বর ছিল, বলিদানে অন্যকে কষ্ট দেওয়া ছিল। কিন্তু, নিজেকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ছিল না। ফলে, সমাজে একটা হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে গেল।
আরও একটা ব্যাপার ঘটালেন তাঁরা। আত্মনির্যাতনেরই একটা অন্য রূপ সেটা। তবে তাতে অন্য একটা ভাবনা রইল। তাতেও অবশ্য জাদু। আগেই বলেছি যে, ধর্মের রূপ ভাবনায় অন্য দেবতাদের অগ্রভাগে ছিলেন সূর্য। ধর্মের ভক্তরা ভাবলেন যে, সূর্যদেব আমাদের চারপাশে ঘুরছেন বলেই দিনরাত হচ্ছে, ঘুরে-ফিরে ঋতু আসছে, আমরা পাচ্ছি বৈচিত্র্যময় ফসল।
ফলে, সূর্যের ঘোরাটা যদি অনুকরণ করা যায়, তাহলে সূর্যদেবকে শ্রদ্ধা জানানো যাবে, তিনি কোনদিনই আর ঘোরা বন্ধ করবেন না, ফলে ফসলের জোগানোও বন্ধ হবে না। এখান থেকেই চড়কগাছ তৈরি করে তাতে নিজেকে বেঁধে সূর্যের প্রতিরূপ হিসেবে ঘোরার প্রথা গাজনের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠল। তাতে উৎসবের সমারোহ আরও বেড়ে গেল।
তথাকথিত উচ্চশ্রেণির এই সমারোহ দেখে গা নিসপিস করে উঠল। অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্যগুলো তাঁদের টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে এ তো হতে দেওয়া যায় না। ফলে, তাঁরা ছুঁতো খুঁজতে লাগলেন অচ্ছুৎ-সৃষ্ট নতুন সংস্কৃতিটি হরণ করার জন্য।
তথাকথিত উচ্চশ্রেণির ধর্ম ঠাকুরের মতোই একটি শিলাময় ঠাকুর ছিলেন, তিনি হলেন শিব। ততদিনে নারীদের ব্রতকথায় নীল হিসেব শিব এসে বসে গেছেন পৌরাণিক আসনের পাশাপাশি লৌকিক দেবতার আসনেও। শিবকে নিয়ে মুখে মুখে তৈরি হয়ে চলেছে লোকসমাজের নতুন ধর্মীয় গল্প।
শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ ততদিনে নিজেদের কৃষিজীবনের সঙ্গে শিবকেও জুড়ে নিয়েছেন। তাঁকে গাঁয়ের কৃষক বানিয়ে ফেলেছেন, গড়ে তুলেছেন 'শিবায়ন'-এর কাহিনি। ফলে, ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েই ছিল, সুযোগ বুঝে এবার বীজ বুনে দেওয়া হল।
চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত ধর্ম ঠাকুরের বিশেষ পুজো অর্থাৎ গাজনের ভেতরে ছিল ধর্ম ঠাকুর ও মুক্তি দেবীর বিবাহ উৎসব। তথাকথিত উচ্চশ্রেণি এই সময় শিবের গাজনের প্রবর্তন করে তা করে তুললেন শিব ও পার্বতীর বিয়ের উৎসব। হরণ করলেন ধর্ম ঠাকুরের গাজনের সমস্ত আচার।
ধীরে ধীরে প্রভাবশালীর পার্বন একদিকে ধর্ম ঠাকুরের গাজনকে স্থানিকতায় সীমাবদ্ধ করল, অন্যদিকে ব্যাপকভাবে নিজের প্রসার ঘটাল।
সমাজ কালে কালে বদলায়, ক্রমে ক্রমে সেও কিছুটা শিথিল হল। তখন তথাকথিত অন্ত্যজশ্রেণির মানুষও শিবের গাজনে সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করলেন। উল্টোদিকে আবার ধর্মের গাজনেও তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ ব্রতী হতে শুরু করলেন।
দুই গাজনের ক্ষেত্রে এবার একটা ভালো ব্যাপার ঘটল। সন্ন্যাস নিলে জাতপাতের ভেদ থাকে না। ফলে, গাজনের তিনদিনও আপামর ভক্তদের মধ্যে সেই ভেদ রইল না। কারও খবরদারি রইল না, অস্পৃশ্যতার হুঁশিয়ারি রইল না, ঠাকুরকে যখন-তখন ছোঁয়ার বাধা রইল না, পুজোর বাধা রইল না, ঠাকুরথানে ইচ্ছেমতন ওঠার বাধা রইল না।
একদা এভাবেই গাজন জল-চল ও জল-অচলকে এক ঘাটে মিলিয়ে দেওয়ার উৎসব হয়ে উঠল। কোথাও কোথাও শিব ও ধর্ম ঠাকুর এক হয়ে গিয়ে এক অনাবিল ঐক্যের সূত্রপাত ঘটালেন। স্বভাবতই, তারই স্রোত বক্ষ্যমাণ গাজন উৎসবের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে আজও...