জগন্নাথের স্নান যাত্রার কথা ও কাহিনি

জগন্নাথের অনেকগুলো লীলা-উৎসবের মধ্যে বিশিষ্ট এক উৎসবের নাম, স্নান যাত্রা। এই উৎসবে জগন্নাথ-বলরাম ও সুভদ্রা মন্দির প্রাঙ্গণের সাজানো লতাবিতানে সর্বসমক্ষে নেমে স্নান করেন।

এদিনের আয়োজনে সমস্তই বিশেষ। তাই স্নানের জল আসে সোনায় বাঁধানো কুয়ো থেকে। স্নানের পর তাঁদের অঙ্গরাগ হয়। তাতে হস্তিসজ্জায় সাজানো হয় জগন্নাথকে। সুভদ্রা সাজেন পদ্মে। 

স্নান যাত্রা উৎসবটি উদযাপিত হয় পূর্ণিমা তিথিতে। এবার এই উৎসবের তিথি-মেলানো দিন নির্ণীত হয়েছে আষাঢ় মাসের নয় তারিখটি। অর্থাৎ কিনা, আজ। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দিনে কেনই বা জগন্নাথের স্নান যাত্রার আয়োজন হয়? আর, স্নানের পরে কেনই বা তাঁর এই হস্তিরূপে সজ্জা?

আসলে মনে করা হয় যে, আজই ভগবান বিষ্ণু দারুকলেবরে পুরীধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিষ্ণু ছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের ইষ্ট। ইষ্টের বাসনা হল কাঠের মূর্তিতে নবরূপে আবির্ভূত হবার। ভক্তকে স্বপ্নে জানালেন সেই বাসনার কথা। 

ঈশ্বরের বাসনায় বাধা আসে না। তাই তাঁর ইচ্ছায় একদিন সমুদ্রে ভেসে এল কাঠ। রাজা সেই কাঠ নিয়ে এলেন ঘরে। কিন্তু, তা দিয়ে বিষ্ণুর নবরূপ খোদাই করতে পারেন, এমন দক্ষ শিল্পী কাউকে পেলেন না তিনি। 

হতাশ হয়ে রাজা যখন হাপিত্যেশ করছেন, তখন বিষ্ণুর আদেশে স্বয়ং বিশ্বকর্মা স্বর্গ থেকে নেমে এলেন। 

JagannathOutfits1

সাধারণ এক ছুতোরের বেশে রাজার কাছে এসে তিনি রাজাকে আশ্বস্ত করলেন যে, ভগবান বিষ্ণুর এমন অপূর্ব রূপ তিনি ফুটিয়ে তুলবেন যা কেউ কখনো দেখেননি। তবে তাঁর একটাই শর্ত, মূর্তি নির্মাণ শেষ হওয়ার আগে অব্দি তিনি থাকবেন একটি বন্ধ কক্ষে, ভুল করেও কেউ সেখানে আসতে পারবেন না। কেউ এলেই তিনি মূর্তি নির্মাণের কাজ ছেড়ে তক্ষুনি চলে যাবেন। রাজা কী আর করেন, মেনে নিলেন তাঁর শর্ত।

বিশ্বকর্মা ঘরের দরজা ভেজিয়ে শুরু করলেন মূর্তি নির্মাণের কাজ। ঘরের বাইরে ভেসে আসতে লাগল অবিরাম ছেনি-হাতুড়ির ঠুক ঠুক আওয়াজ। বেশ চলছিল, কিন্তু তার মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই সেই আওয়াজ গেল থেমে। রাজা-রানি ভাবলেন, ব্যাপারটা কী? মূর্তি তৈরি কি তাহলে সম্পুর্ণ? 

তারপর ভাবলেন, তা-ই বা কী করে হয়। তেমন হলে কথামতো ছুতোর তো এসে খবর দিত! তাহলে কি লোকটা অসুস্থ হয়ে পড়ল! 

এমন ভাবনা প্রবল হতেই উচাটন হয়ে উঠল মন। অমনি দরজা খুলে দেখতে গেলেন ব্যাপারখানা কী, আর তখনই ঘটে গেল অঘটন। ছুতোর চোখের সামনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে রয়ে গেল শুধু তিনটি মূর্তি। হাত নেই, পা নেই, আবক্ষ ঈশ্বর। জগন্নাথ, বলদেব আর সুভদ্রা। 

শিল্পী মূর্তি সম্পূর্ণ করেননি ঠিকই, কিন্তু রচনা করে গেছেন বিগ্রহের অপূর্ব মোহময় চোখ! সে চোখের দিকে তাকিয়ে আশ যেন মেটে না। মনে হয় ব্রহ্মাণ্ডের অপার রূপ আর রহস্যময়তা ধরা পড়েছে তাতে, অপলক চেয়েও সে রহস্যের ঘোর যেন কিছুতেই কাটে না!

রাজারানি বুঝলেন এই অনন্য রূপ ও কলেবরেই হয়তো ভগবান আবির্ভূত হতে চেয়েছিলেন। আর এভাবেই তিনি সেটি নির্মাণ করিয়ে নিলেন। আসলে, এ তাঁরই লীলা...যে লীলায় অসম্পূর্ণ অবয়বে ধরা দিয়েছে সম্পূর্ণতা, গড়ে উঠেছে অনন্য বিগ্রহ...

সেই অনন্য বিগ্রহের আকারে আদিম শিল্পের ছাপ, চোখের তারায় চিরন্তন চেতনা। সেই চোখের টানেই বার বার ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে। 

LordJagannath1

যাই হোক, ওই তিন অসম্পূর্ণ বিগ্রহই রাজারানি প্রতিষ্ঠা করলেন মন্দিরে। আজকের দিনটি জগন্নাথের সেই দারুমূর্তিরূপে মর্ত্যে আবির্ভাবের দিন, জন্মদিন। তাই আজকের স্নানটি হল বিশেষ স্নান, তাকেই মহিমান্বিত করে বলা হচ্ছে, 'স্নান যাত্রা'।

জনশ্রুতি বলে, এমনই এক স্নান যাত্রার দিন ভগবান জগন্নাথকে দেখতে সুদূর গুজরাত থেকে সাধক গণপতি ভট্ট এসেছিলেন পুরীধামে। 

গণপতির ইষ্ট দেবতা ছিলেন বিষ্ণু। তাই বিষ্ণুর নবকলেবর-নবরূপ দেখার আকুলতা নিয়ে তিনি এতটা পথ অতিক্রম করেছিলেন মাসের পর মাস, দিনরাতের তফাৎ ভুলে বনপথের বিপদ মাথায় নিয়ে। 

তিনি শুনেছিলেন যে, বিষ্ণু পুরীধামে হস্তিমুখ নিয়ে আবির্ভুত হয়েছেন। সেই অদ্ভুতরূপেই তাঁকে দেখার প্রবল বাসনা নিয়েই তিনি ছুটে এসেছিলেন। তাই জগন্নাথকে দেখে তিনি হতাশ হলেন। স্নানযাত্রার সময় কাছ থেকে জগন্নাথের মোহময় চোখে চোখ রেখেও হস্তিমুখ দেখার বাসনা গেল না তাঁর। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনের আশ মনে চেপে ঘরে ফেরার পথ ধরলেন তিনি।

অন্তর্যামী ভগবান বুঝলেন ভক্তের মনের কথা। ভক্তের অতৃপ্তির ব্যথা। ভক্ত তাঁকে যে রূপে দেখতে চান, তিনি তাঁকে সে রূপেই দেখা দেন। 

তাই বিষ্ণু রাজাকে স্বপ্ন দিলেন। বললেন, জগন্নাথকে হস্তিমুখ সাজে সাজানোর কথা। আর বললেন, গৃহমুখী পরমভক্ত গণপতিকে পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। 

রাজা তখন ভগবান জগন্নাথকে হস্তিমুখসজ্জা দিলেন, পথ থেকে আপ্যায়ন করে ডেকে আনলেন সাধক গণপতিকে। 

তখন মন্দিরে এসে গণপতি নয়ন তৃপ্ত করে দেখলেন, হস্তিমুখ জগন্নাথকে। দেখলেন, তাঁর ঈপ্সিত ইষ্ট শুঁড় দিয়ে গ্রহণ করছেন নৈবেদ্য!

এভাবে এই সময় থেকেই শুরু হল স্নান যাত্রার দিন জগন্নাথ বিগ্রহকে হস্তিসজ্জায় সাজানোর প্রথা।

পরিশেষে বলি, স্নান যাত্রার পর থেকেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিশ্রামের কাল শুরু হয়; আর শুরু হয় রথযাত্রার জন্য এক পক্ষকালের অপেক্ষা--ঈশ্বর ও ভক্ত দুজনেরই...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...