সকলই প্রস্তুত। মহাপ্রভু নদিয়া ছেড়ে নীলাচলে পাড়ি দিচ্ছেন পুরুষোত্তম জগন্নাথকে আশ্রয় করতে। সকলেই তাঁকে বিদায় দিচ্ছেন। ভক্ত হরিদাসও এলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে এসে একেবারে পায়ে পড়ে গেলেন মহাপ্রভুর। পথ আটকাতে চাইলেন।
ভক্ত হরিদাস। লোকে ডাকে, ‘যবন হরিদাস’। কেউ বলেন, তিনি নাকি মুসলিম-সন্তান। আবার কেউ বলেন, ব্রাহ্মণের অনাথ সন্তান, মুসলমানের ঘরে প্রতিপালিত। তবে, মহাপ্রভুর কাছে তিনি জাতপাতের ঊর্ধ্বে একজন পরমভক্ত, ভক্তশ্রেষ্ঠ--তাঁর উপরে আর কেউ নেই। তাই মহাপ্রভু-পদনিষ্ঠ হরিদাস কেঁদে পড়লেন তাঁর পায়ে।
কেঁদে পায়ে পড়লেন। কারণ, এ-যাত্রায় মহাপ্রভু একা চলেছেন নীলাচলের পথে। বিশ দিনের পথ পদব্রজে যাবেন। পথ প্রায় অরণ্যময়। তাতে পদে পদে প্রাণঘাতী দস্যুদের ভয়। সেই পথে প্রভুকে কেমন করে একা যেতে দেবেন ভক্ত হরিদাস! তাছাড়া, তাঁকে ছেড়ে হরিদাস কেমন করেই বা একা পড়ে থাকবেন এই ইষ্টশূন্য নবদ্বীপে!
ভক্তের আকুতি বুঝে মহাপ্রভু তাঁকে চরণ থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, নবদ্বীপ থেকে নীলাচল মাত্র তো বিংশতি দিনের পথ। তোমার যখনই ইচ্ছে হবে তুমি আমার কাছে চলে এসো, আমার জগন্নাথের কাছে চলে এসো, কেমন!
তবু, হরিদাসের মন মানল না। তিনি জানেন, মহাপ্রভু নীলাচলে চলেছেন তাঁর প্রাণের ঠাকুরের কাছে। ঠাকুরের ভদ্রাসন পুরীর মন্দিরই হবে তাঁর আশ্রয়। কিন্তু, সেই আশ্রয়ে তো হরিদাসের ঠাঁই হবে না। সেখানে যে ‘যবন’-এর প্রবেশাধিকারই নেই!
হরিদাসের বাস্তব আশঙ্কার কথা শুনে মহাপ্রভু লীলাময়ের মতো হাসলেন। হেসে বুঝিয়ে দিলেন, মেলাবেন তিনি, তিনিই সব মিলিয়ে দেবেন। তুমি নীলাচলে এসো। আমি আছি তো!
মহাপ্রভু নবদ্বীপ ছেড়ে নীলাচলে চলে গেলেন। যেন, অক্রুর-সংবাদে কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে চলে গেলেন মথুরায়।
কতদিন কেটে গেল। নবদ্বীপের ভক্তদের মন ক্রমশ উচাটন হতে লাগল প্রভুকে দেখার জন্য। তাঁরা দলে দলে বঙ্গ থেকে আসতে লাগলেন কলিঙ্গে। সচল জগন্নাথ আর অচল জগন্নাথ--দুজনকে একত্রে দেখে ধন্য হতে লাগলেন। সেই পথ ধরে একদিন হরিদাসও এলেন।
হরিদাস এসেছেন শুনে মহাপ্রভু ছুটে এলেন তাঁর কাছে। সবেগে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন। এতদিন পর তাঁর বুকের আশ্রয়টি পেয়ে হরিদাসের সুখের অবধি রইল না। কিন্তু, সেই সঙ্গে তাঁর অন্তরে খানিক দুঃখও হল। পদপ্রান্তে এসেও ইষ্টের ইষ্ট জগন্নাথকে দর্শন করতে পারবেন না, তাঁর পরশ নিতে পারবেন না!
মহাপ্রভু ভক্তের ব্যথার কথা জানলেন। অমনি তিনি হরিদাসের থাকার ব্যবস্থা করলেন শ্রীমন্দিরের সামনের একটি বাগানে। যেখান থেকে জগন্নাথ মন্দিরের রথচক্র স্পষ্ট দেখা যায়। হরিদাস যাতে জগন্নাথের নিত্যপ্রসাদ পেতে পারেন, তার ব্যবস্থাও করে দিলেন। এটুকু পেয়েই হরিদাসের আনন্দের অন্ত রইল না। অন্তরে শুধু রইল জগন্নাথকে দর্শন ও স্পর্শনের অপেক্ষা। মহাপ্রভুর কৃপায় একদিন সেই অপেক্ষারও অন্ত হল।
সে-বার রথযাত্রায় প্রাণের ঠাকুরের পথচলাকে আরও আনন্দময় করে তুলতে মহাপ্রভু আয়োজন করলেন গীতসুধা কীর্তন পরিবেশনের। সেই মতো রথের দিন জগন্নাথদেবের রথের চারিদিকে চারটে কীর্তনের দল স্থাপন করলেন। এরই একটি দলের নেতৃত্বভার দিলেন হরিদাসকে। হরিদাস কৃতার্থ হলেন।
শ্রীখোলে বোল উঠতেই আবেশে হরিদাসের দু'নয়নে বৃষ্টি নামল, কণ্ঠ বেয়ে উঠে এল হৃদয়-নিংড়ানো কীর্তন। সেই সমর্পিত কীর্তন শুনে জগন্নাথের বুক যেন জুড়িয়ে গেল, কান হল সুতৃপ্ত। ভাবাবিষ্ট হলেন মহাপ্রভু। সেই আবেশে তিনি হলেন ভাবনৃত্যে আত্মহারা।
তারপর এল উল্টোরথ।
উল্টোরথের দিন গুণ্ডিচা থেকে শ্রীমন্দিরে ফেরার পথে স্বর্গদ্বারের সামনে এসে প্রতিবার থেমে যায় জগন্নাথের রথ। এ-সময় তাঁর গায়ে থাকে চন্দনী সুবাস। সেই সুবাস ভক্তকুলের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেবার জন্যই যেন তাঁর অপেক্ষা।
কারণ, এই ক্ষণটিতেই জাতিবর্ণধর্ম নির্বিশেষে সকলেই রথে উঠে প্রাণের ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরার, একান্ত করে অবলোকন করার, তাঁর দেহের সুবাস গায়ে মাখার সৌভাগ্য লাভ করেন। এখানে সর্বজনের স্পর্শ নিয়ে, সকলকে স্পর্শ দিয়ে তবেই জগন্নাথ রাজবেশ ধারণ করেন, ছেড়ে যাওয়া রত্নবেদীর আসন গ্রহণ করেন।
উল্টোরথের সেই সন্ধিক্ষণে ভক্ত হরিদাসও পেলেন ইষ্টের ইষ্ট জগন্নাথদেবের পরশ। ধন্য হলেন। পূর্ণ হল তাঁর জীবনে নীলাচলের অচল জগন্নাথ আর নবদ্বীপের সচল জগন্নাথের পরম সাহচর্য ও পরম কৃপাপ্রাপ্তির বৃত্ত। আর সেই কৃপার ফলেই হয়তো একদিন তিনি এই জগন্নাথভূমিতে মহাপ্রভুর কোলে মাথা রেখে অন্তিমে বিলীন হতে পেরেছিলেন।