আপামর ভোজন রসিক কুলের রসনাতৃপ্তির একাধিক মাধ্যমের অন্যতম হলো মিহিদানা। তার সাথে টক দই - আহা সে যেন স্বর্গীয় অনুভূতি। সেই মিহিদানা কিন্তু একান্তই বর্ধমানবাসীর গর্বের বিষয়। তার উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ, ঘ্রান, স্বাদের মাহাত্বের জন্য সে সর্ব মহলেই সমাদৃত। কিন্তু বিগত কিছু বছরে বাংলার বেশ কিছু মিষ্টি তার আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের সম্মুখীন হয়েছে। এই মিহিদানাও তা থেকে রেহাই পায় নি।
তবে ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ জিআই রেজিস্ট্রেশনের স্বীকৃতির সাথে মিহিদানা তার নাগরিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে স্বীকৃত হয় যে এই দুই মিষ্টি শুধুমাত্র বর্ধমানের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বর্ধমান মানেই মিহিদানা আর মিহিদানা মানেই বর্ধমান - এই সত্যি প্রত্যেক বাঙালিই একবাক্যে স্বীকার করে নেবেন। এবার নামের স্বার্থকতা বলি - মিহি অর্থে সূক্ষ্ম এবং দানা অর্থে শস্য – সেই থেকেই জন্ম হল মিহিদানার। কিন্তু এই জন্মের একটি ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত আছে - আজ সে কথাই বলবো।
নগেন্দ্রনাথ নাগের মতে, তাঁর পিতামহ ক্ষেত্রনাথ নাগ মহারাজা মেহেতাবচাঁদ বাহাদুরের শাসনকালে প্রথম বর্ধমানে বিশেষ সীতভোগ ও মিহিদানা আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কারের পঁয়ত্রিশ বছর পরে ১৯০৪ সালের ১৯ আগষ্ট লর্ড কার্জন আসেন বর্ধমানে। সেইসময় বর্ধমানের মহারাজ বিজয়চাঁদ মেহেতাব বর্ধমানের বিশিষ্ট মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ভৈরবচন্দ্র নাগকে বিশেষ ধরনের মিষ্টি প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন , যাতে লর্ড কার্জন সম্মানিত হন এবং বাংলার মিষ্টির স্বাদ যেন তার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
লর্ড কার্জনকে স্বাগত জানাতেই ভৈরবচন্দ্র নাগ তৈরি করলেন মিহিদানা। যা খেয়ে লর্ড কার্জন অভিভূত হয়ে যান। ভৈরবচন্দ্র নাগকে শংসাপত্রের মাধ্যমে প্রশংসা ও ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, যে তিনি এর আগে কখনও এ জাতীয় মিষ্টি পান নি। এই মিষ্টি তাঁর মূল্যায়নের পর সমগ্র ভারতে সুনাম অর্জন করেছিল। তারপরে, এই মিষ্টির গুণমান এবং নাম বিদেশেও পৌঁছে যায়। প্রয়াত ভৈরবচন্দ্র নাগের পুত্র প্রয়াত নগেন্দ্রনাথ নাগ এই ঘটনাটি রেডিওতে প্রচার করেছিলেন। অর্থাৎ মিহিদানার ইতিহাস আজ থেকে ১১৫ বছর আগের। বাঙালি কিন্তু এই ইতিহাস ভুলে যায়নি। বরং, বংশ পরম্পরায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিহিদানা একেবারে বাড়ির মিষ্টি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি সীতাভোগও কম যায় না।
মিহিদানা তৈরির পদ্ধতিটিও বেশ অন্যরকম। মিহিদানার প্রধান উপাদান কিন্তু চাল। সাধারণত গোবিন্দভোগ, কামিনীভোগ অথবা বাসমতী চাল ব্যবহার করা হয়। চাল গুঁড়ো করে তার সঙ্গে বেসন, জাফরান ও জল মিশিয়ে একটি থকথকে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। একটি ছিদ্রযুক্ত পেতলের পাত্র থেকে সেই মিশ্রণ কড়াইতে ফুটন্ত গাওয়া ঘিতে ফেলা হয়। তারপর দানাগুলি কড়া করে ভেজে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তুলে চিনির রসে রাখা হয়। ব্যাস, তৈরি মিহিদানা। তবে এই কায়দা রপ্ত সহজ নয়, পদ্ধতি সহজ মনে হতেই পারে। কিন্তু বর্ধমান স্পেশাল হলুদ রঙা মিহিদানা বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে চেখে দেখতেই হবে।
বাঙালি কবি-শিল্পীরাও সেই কবে থেকে মিহিদানায় মজে আছেন। এই মিষ্টিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে কত কত গান, সাহিত্য। সুকুমার রায় , রজনীকান্ত সেন ও এই তালিকাভুক্ত । তাঁর ১৯০৫ সালের কল্যাণী’ কাব্যগ্রন্থের রঙ্গ রসাত্মক সংগীতে বাংলার ভিন্ন মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। মিহিদানা তৈরি হচ্ছে ১৯০৪-এ। আর তার ঠিক পরের বছরেই তা নিয়ে গান লিখলেন রজনীকান্ত। একবছরের মধ্যেই যে মিহিদানা সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজও তার কদর সমান ভাবেই বিদ্যমান। তবে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ঘি বিষয়ে উদারতা না দেখালে তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু অল টাইম হিট এই মিহিদানার আজ জুড়ি মেলা ভার। কলকাতাতেও এর চাহিদা বেশ খাসা। তাই অম্বলের চোখ রাঙানি এড়িয়ে চেখে দেখতেই পারেন।