প্রতিদিন মাহেন্দ্রক্ষণে সমুদ্রস্নান সেরে জগন্নাথ দর্শন করতেন শ্রী চৈতন্যদেব

নদিয়া নবদ্বীপের ভূমি শাস্ত্রচর্চার লীলাক্ষেত্র। সেখানে অন্যতম নাম জগন্নাথ মিশ্র। তাঁর জ্ঞান-শাস্ত্র-ভক্তিরস চর্চার ধারা প্রবাহিত হয়েছিল তাঁর দুইপুত্র বিশ্বরূপ ও বিশ্বম্ভরের মধ্যেও।

সেই টানেই সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়েছিল জ্যেষ্ঠপুত্র বিশ্বরূপ। কনিষ্ঠ বিশ্বম্ভর ওরফে নিমাই পণ্ডিত চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। নিমাই পন্ডিত থেকে হয়ে ওঠেন নিমাই সন্ন্যাসী।

সন্ন্যাস গ্রহণের পর আমূল বদল আসে তাঁর জীবনে। শিক্ষাভিমানী জ্ঞানাচারী থেকে হয়ে ওঠেন কৃষ্ণপ্রেমে আকুল এক ভক্ত।

গয়ায় পিন্ডদান করতে গিয়ে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে বৈরাগ্যের দীক্ষা নেন। পূর্বাশ্রমের নাম ত্যাগ করে তাঁর নতুন নাম হয় শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। সন্ন্যাস গ্রহ্ণের পর নিমাই সন্ন্যাসী বৃন্দাবন যেতে চাইলেন। কেঁদে পড়লেন শচীদেবী।

কনিষ্ঠ পুত্রকে হারাবার ভয় ছিল তাঁর। তাই বললেন, বৃন্দাবন অনেক দূর, তার চেয়ে বরং নীলাচল যাত্রা করুক নিমাই। তাহলে ছেলের খব তিনি পাবেন।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত’র মধ্যলীলা অনুযায়ী, নীলাচলে যাওয়াই স্থির করেন তিনি। মা এবং নবদ্বীপবাসীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি নীলাচল যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গী তাঁর চার অন্তরঙ্গ ভক্ত। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, জগদানন্দ পন্ডিত, দামোদর পন্ডিত এবং মুকুন্দ দত্ত।

নীলাচল যাত্রার সময় থেকেই কৃষ্ণপ্রেমে আকুল চৈতন্যের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জুড়ে গেলেন প্রভু জগন্নাথ।   

শ্রী চৈতন্যদেবের নীলাচলে আসার মূল কারণ ছিলেন প্রভু জগন্নাথ। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর জীবন। শ্রী চৈতন্যদেবের ব্যপ্তি এবং লীন হয়ে যাওয়াও প্রভুপাদেই। তাঁর কাছে কৃষ্ণই জগন্নাথ।

রেমুনা থেকে জাজপুর, সেখান থেকে কটক হয়ে ভুবনেশ্বরের পথে তিনি শ্রীক্ষেত্র পৌঁছান। তার মাঝেই পথক্লান্ত শ্রী চৈতন্য তাঁর সঙ্গীদের কাছে নদীতে স্নানের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিছুক্ষণের বিরতি নেন তাঁরা। জগদানন্দ পণ্ডিতকে নিজের হাতের দন্ডখানি রাখতে দিয়ে স্নানে যান। জগদানন্দ পন্ডিত সেই দণ্ডখানি নিত্যানন্দের হাতে দিয়ে চৈতন্যপ্রভুর জন্য খাবার প্রস্তুত করতে যান।

নিত্যানন্দ মনে মনে ভাবলেন রাম অবতারে তিনি অস্ত্র ধরে অসুরের সংহার করেছিলেন। লাঠিও তো অস্ত্র। মহাপ্রভু প্রেম রসে নবদ্বীপ-কলিঙ্গ ভাসাবেন, চৈতন্য অবতারে তাঁর অস্ত্রের কিবা প্রয়োজন? তাই দন্ডটিকে তিন খন্ড করে ভেঙ্গে নদীর জলে ফেলে দিলেন তিনি।

তাঁর এমন কান্ডে চৈতন্যদেব যে রাগান্বিত হবেন, সে ভাবনাও তাঁর মনে ছিল। ঘটলও তাই! মহাপ্রভু প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে সঙ্গীদের পিছনে ফেলে হনহন করে এগিয়ে গেলেন। কাউকেই সঙ্গে নিলেন না। ভাবোন্মাদ হয়ে আঠারোনালা সেতু পেরিয়ে এগিয়ে চললেন জগন্নাথ মন্দিরের দিকে।

মন্দিরে দারুবিগ্রহের সামনে দাঁড়াতেই কৃষ্ণপ্রেমে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। দু’চোখে আনন্দাশ্রু। বিগ্রহকে আলিঙ্গন করার জন্য হা জগন্নাথ হা জগন্নাথ করতে করতে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন তিনি। সেই মুহূর্তেই প্রভু চৈতন্যের কৃষ্ণভাব জগন্নাথের অঙ্গে চিরতরে লীন হয়ে গিয়ে জেগে থাকল শুধু রাধাভাব।

চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের বাকি চব্বিশ বছরের আঠারো বছর কেটেছিল শ্রী ক্ষেত্রেই। বাকি ছয় বছরে বাংলা, দাক্ষিণাত্য, মথুরা, বৃন্দাবন সহ ছয়টি ধর্মযাত্রা করেছিলেন তিনি।

বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা চৈতন্যদেবের টানে নীলাচল আসতেন যবন হরিদাসও সেভাবেই এসেছিলেন নীলাচলে। উচ্চ-নীচ ভেদ ছিল না তাঁর কাছে। সবাইকে তিনি কাছে টেনে নিতেন।

প্রতিদিন মাহেন্দ্রক্ষণে সমুদ্রস্নান সেরে জগন্নাথ দর্শন করতেন শ্রী চৈতন্যদেব। প্রভু জগন্নাথের মঙ্গলারতির পর তাঁর অনেকটা সময় কেটে যেত মন্দিরেই। সন্ধেবেলা বার যেতেন দর্শনে। একা নয়, সকল ভক্তকে সঙ্গে নিয়ে। সংকীর্তনের সুরে, ভক্তিরসে ভেসে যেত কলিঙ্গবাসী।

আষাঢ়ের শুক্লপক্ষে রথযাত্রার সময় একবার মহাপ্রভুর ইচ্ছে হল তিনি প্রভু জগন্নাথের মাধুর্যলীলার কুঞ্জবন গুন্ডিচা মার্জনা করবেন। রথ বেদিকে সাজিয়ে তুলবেন তিনি। তাঁর নির্দেশে ভক্তরা মন্দির চত্বর প্রক্ষালন করলেন।

জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা গোটা পথ চন্দন জলে ধুয়ে ফেললেন দয়িতপতিরা। সে কাজে হাত লাগিয়েছনে রাজাও।

 রথযাত্রার দিন যাত্রা শুরুর পূর্বে মহাপ্রভু তাঁর সব ভক্তদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিলেন। প্রত্যেকের গলায় মালা। তাঁর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতম ভক্তরা। স্বরূপ দামোদর এবং শ্রীবাস কীর্তন গাইয়ে সম্প্রদায়ের দলপতি। মৃদঙ্গ ও নৃত্য সম্প্রদায়। রথের আগে পরে জগন্নাথ ধবনি দিয়ে চলতে লাগলেন তাঁরা। নামগানে মগ্ন মহাপ্রভু।

পাঁচশো বছর আগের বালুপথ পথ দিয়ে চলেছে প্রভু জগন্নাথের রথ। এ পথ যেন বৃন্দাবনের পথ। কৃষ্ণ আর জগন্নাথ একাকার হয়ে গিয়েছেন। মানবপ্রেমে মিশে গিয়েছেন মহাপ্রভুও। উচ্চ-নীচ-ধনী-দরিদ্র সমস্ত ভেদাভেদের উর্ধে এক যুগ পুরুষ হয়ে। মানব প্রেমের বাণীতে চৈতন্য-উদয় হয়েছিল বাংলার ইতিহাসে।

 

তথ্যসূত্রঃ (কৃষ্ণদাস কবিরাজঃ চৈতন্য চরিতামৃত)         

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...