এই কন্যা স্বাধীন। মুক্ত। রাত বিরেতে উড়ে বেড়ান বাহনে চড়ে। যার ঘরে দীপ জ্বলেনি তার ঘরে আলো দেন।
আকাশ ছুঁয়ে, অন্ধকার ছুঁয়ে ডাক দিয়ে যান, ‘কো জাগর্তি...কো জাগর্তি’
সমুদ্রজাতা কন্যা ঘর খুঁজে ফেরেন। মাটির প্রদীপের আলোয় আসন পিঁড়ির টান। ধানের ছড়ায়, পদ্মগন্ধে আলতা পায়ের দাগ রেখে যান দীনের কুটিরে।
সারা বছর ধরে আধুলি জমতে থাকে কড়ির ঝাঁপিতে। বছর শেষে পূর্ণ হয়ে ওঠে খালি ঝাঁপি। কমলার আসনের পাশে রাখা লাল রঙের ছাপোসা ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’। কোজাগরী দিনে তাই দিয়ে দেবীর আসন পাতা হবে।
তিনি ধন, ঐশ্বর্য, সম্পদের দেবী তবু যেন ঘরের মেয়ে। জাঁকের বিপ্রতীপে সহজ। ধানের শিষে, মাটির পটে লাবণ্যপ্রভায় উজ্জ্বল।
প্রাচুর্যের দেবী হয়েও রত্নসিংহাসন নয়, কমল আসনে বিরাজমানা। নিশি জাগানিয়া কমলা সাদা প্যাঁচার পিঠে চেপে অন্ধকারের মাঝে জ্যোৎস্না ছুঁয়ে ঘুরে বেড়ান। আলোর খোঁজে। মাটির বুকে কে জাগে রাত। দীপমালার বিভায় আকুল কামনায় কে খোঁজে শ্রী। সে ঘরেই নেমে আসেন তিনি। হাতে কলস, ধানের ছড়ায় বরদাময়ী। কোজাগরী লক্ষ্মী।
অমৃত মন্থনের সময় অগাধ সমুদ্রের তল থেকে উৎপত্তি পদ্মাসনার। বৈকুণ্ঠ ছেড়ে আসীন হয়েছিলেন সমুদ্র তলদেশে। তাঁর আগমনে শ্রী ফেরে অমরাবতীতে। শ্রী ফেরে মর্ত্যের মাটিতেও। অনাহার, দুর্ভিক্ষ, রোগ-মারী, জীর্ণতায় দুঃস্থ মানুষ হারানো সমৃদ্ধি ফিরে পায়। উৎসব আসে লক্ষ্মী ছাড়া জীবনে।
বৈভবের অধীশ্বরী হয়েও আতিশয্যহীন। দেবীভাবনা যেন অন্য জীবন দর্শনের খোঁজ দেয়। মানব জীবনের সহজিয়া সুরটুকু বেজে ওঠে অর্চনায়। দেবী লক্ষ্মী শুধু ধন সম্পদে না জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, সৌন্দর্য, সুরুচির দেবী। বাহুল্য বর্জিত যাপনের পরিমিতি বোধ শেখায় লক্ষ্মী দর্শন।
দেবীত্বের আধারেও তিনি যেন রক্তমাংসের। আটপৌরে ঘরের মেয়ে। আলতা ডোবানো পা, এলোচুল, লালপেড়ে শাড়ি, পদ্মদল হাতে ধানক্ষেতের মেঠোপথে, নদীর চরে ভেসে বেড়ান। ঘরের কোণে পিঁড়ি পেতে বসেন। যুদ্ধ জয়ের ঝংকার নয়, ক্ষমতার আস্ফালন নয়, তিনি শান্ত, সমাহিত।
সামান্য উপাচারেই তিনি সন্তুষ্ট। পেঁচা, কড়ি, চিঁড়ে, খই, পিটুলির আল্পনা তাঁর পুজো উপাচার।
বাংলায় প্রচলিত লক্ষ্মীর পাঁচালির আদি লিপিকার কে তার কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে পাঁচালির পংক্তিতে ফিরে আসে মন্বন্তরের কথা। ঘরে ঘরে অনাহার। অসহিষ্ণুতার কাহিনী। সেই পরিস্থিতিতেই লক্ষ্মী আসেন ঘরে।
তবে তিনি চঞ্চলা। হিংসা-দ্বেষ-অশান্তির আবহে গৃহত্যাগী হন। লক্ষ্মীর আগমনী কথার অন্তরে বারবার যেন শান্তি, অহিংসা, প্রেম আর সমৃদ্ধির বিশ্ব বাণী শোনা যায়। সেই বাণী বলে, কমলাসনার আসল ঠাঁই ভক্তের হৃদকমলে। কিন্তু সেই পদ্মটিই অধরা। দ্বেষ-ব্যস্ত হৃদয় যেন বড় শ্রীহীন।
লক্ষ্মী তাঁর অমল মাধুরীতে কোথায় অধিষ্ঠান করবেন?
খুব নিভৃতে যেন উত্তর ভেসে আসে। শাঁখের শব্দে, সাঁঝবাতি্র আলোয়, থৈ থৈ জ্যোৎস্নায় ভাঙা ঘরের অন্দর থেকে এক মনে কে পড়ে চলে,
আঁকিলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা।
শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’