নির্মাণের দেবতা হিসেবে সম্পূর্ণ দেব লোকের কাছে বিশ্বকর্মাই পরিচিত। কঠিন, জটিল, নির্মাণ কাজ বিশ্বকর্মার হাত ধরেই হয়েছে। এই বিশ্বকর্মা নাকি একবার ভারী অহংকারী হয়ে পড়ে। বাকি দেবতাদের পরোয়াই করতেন না। নিজের প্রশংসায় বলতেন-"এই গোটা স্বর্গে কিংবা মর্ত্যে আমার থেকে শ্রেষ্ঠ কি আর কেউ আছে?" বিশ্বকর্মার এই আত্মতুষ্টি ধীরে ধীরে বাড়লো বই কমলো না। এমনকী আত্ম অহংকারে বিশ্বকর্মা কাজ করাও বন্ধ করে দিল। ফলে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ের সমস্ত নির্মাণ কাজ স্তব্ধ হয়ে গেল। দেবতারা খুব চিন্তিত। সকলে মিলে আলোচনা করে বুঝলেন বিশ্বকর্মার অহংকার চূর্ণ না করতে পারলে তাঁকে আগের মত কাজের জগতে ফেরানো যাবে না।
এদিকে নির্মাণ কাজ যদি এভাবে থেমে থাকে সৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে যাবে। সভ্যতার গতিপথ রুদ্ধ হবে। দেবলোকের দেবতাদের কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ। বিশ্বকর্মাকে প্রথম দিকে অনুরোধ করা হলো। অহংকার ত্যাগ করে নিজের স্বাভাবিক কাজকর্ম করা জীবনে ফেরার কথা তাঁকে বলা হলো। কিন্তু বিশ্বকর্মার সেই দিকে মন নেই। দেবতাদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এই ভাবনায় তখন মত্ত। অনেক ভেবে দেবতারা ঠিক করলেন কাজ দিয়েই তাঁর অহংকার ভাঙতে হবে। কাজেই বিশ্বকর্মার সমপর্যায়ে কাউকে খুজে বের করতে হবে। স্বর্গ মর্ত্য পাতাল খোঁজা হল। অবশেষে পাতালে একজনকে পাওয়া গেল যিনি কর্মক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বকর্মার মতই। দেবতারা নিজেরা গিয়ে পাতালের ওই দেবতার কাজ দেখে এলেন। এই দেবতার নাম লোহাসুর। পাতালের সমস্ত নির্মাণ কাজই তিনি করেন।
লোহাসুরকে নিয়ে দেবতারা মর্ত্যে এলেন। মর্ত্যে পৌঁছে লোহাসুরকে দেবতারা আদেশ করলেন যে যতদিন না বিশ্বকর্মার অহংকার কমছে ততদিন বিশ্বকর্মার অসম্পূর্ণ নির্মাণ কাজ এই দেবতাকে করে যেতে হবে। শুধু তাই নয় আগামী দিনের সমস্ত নির্মাণ কাজের দায়িত্ব এই দেবতার ওপর অর্পিত থাকবে। তবে বিশ্বকর্মা কখনো ফিরে এলে এই দেবতাকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। প্রথম দিকে লোহাসুর রাজি হতে চাইছিলেন না। তিনি জানেন তিনিও বিশ্বকর্মার মতোই নিখুঁত কাজ করতে পারেন। কিন্তু বিশ্বকর্মার পরিণতি দেখে লোহাসুর উপলব্ধি করেন যে অহংকার আসলে সৃষ্টির গতিপথ থামিয়ে দিতে পারে। তাই ধীরে ধীরে তিনি রাজি হলেন সমস্ত নির্মাণ কাজ করার জন্য। দেবতারাও খুশি হয়ে লোহাসুরকে বর দিয়েছিলেন যে তিনি মর্ত্যেও পুজিত হবেন। লোহাসুরের কাজ দেখে বিশ্বকর্মার দম্ভ চূর্ণ হয়। তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি এই নির্মাণ শ্রেষ্ঠ দেবতা নয়। তার মত এমন দেবতা পাতালেও রয়েছে। কিন্তু লোহাসুরের পুজোর প্রচলন শুরু হয়ে গেছে ততদিনে।
সুদর্শন চেহারার মূর্তি। লম্বা চুল, ফর্সা গায়ের রং, দুটো হাত, দুহাতেই অস্ত্র ধরা। পরোনি ধুতি, খালি গা। এমনই দেখতে লোহাসুরকে। প্রতিবছর নতুন করে মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করা হয় মধ্য কামাখ্যাগুড়িতে। এই কামাখ্যা ধামে কামাখ্যা মা এবং অন্যান্য আরো ১৭ জন দেব দেবীর সঙ্গে লোহাসুরের পুজো হয় আষাঢ় মাসের ১১ তারিখে। পুজোর আগে লাল শালুতে মোড়ানো বাঁশকে কেন্দ্র করে মন্ত্র পড়ে জাগিয়ে তুলে সেগুলোকে থানের সামনে পুঁতে রাখা হয়। তারপর পুজোর আগে পাঁচদিন এই বাঁশ নিয়ে বাড়ি বাড়ি বাজার হাট, বাজনা বাজিয়ে নাচতে নাচতে মাগনা সংগ্রহ করা হয় । মধ্য কামাখ্যাগুড়ির উপদেবতা লোহাসুর।
কথিত আছে লোহাসুর কারোর উপর অসন্তুষ্ট হলে ওই ব্যক্তিকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির পেটে ব্যথা হয় এবং শরীরের একটা বিশেষ অংশ অবশ হয়ে শরীর লোহার মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। তখন আক্রান্ত ব্যক্তিসমেত হাজির হয়ে লোহাসুরের কাছে মানত করতে হয়। দই, চিড়ে, গুড় আর বীজ কলা দিয়ে লোহাসুরকে পুজো দিতে হয়।। এছাড়া পুজোয় একটা লাল নিশান লাগে। এই পুজোয় কোন বলি প্রথা নেই। মধ্যকামাখ্যাগুড়িতে বাৎসরিক পুজো ছাড়াও নিত্য পুজো হয় লোহাসুরের। মধ্য কামাখ্যাগুড়ি স্থানীয় জনশ্রুতি ছাড়া মধ্যপ্রদেশের লোহাপুরের একটি জনশ্রুতি এবং হিমাচল প্রদেশেও একটি দেবতাকে লোহাসুরের মতো করেই পুজো করা হয়।। তবে এই দুই ক্ষেত্রেই প্রভাব রয়েছে বিশ্বকর্মার অর্থাৎ বিশ্বকর্মার কোন একটা কীর্তির জন্যই এই লোহাসুর নামের লৌকিক দেবতার জন্ম হয়েছিল।