সমস্যার সমাধানে স্থানীয় পদ্ধতি

আমাদের ভূগর্ভস্থ জলের যে ব্যবহার করেছি আমরা এত দিন, তা কি আমরা হিসেব করে করেছি কোনো সময়? মাটির তলার সঞ্চিত সম্পদ ওপরে এনে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছি আমরা পাম্পের আবিষ্কার করে। শিল্পকাজে এবং কৃষিকাজে জল ব্যবহার করেছি আমরা আমাদের ইচ্ছামত, বলা ভালো যথেচ্ছভাবে। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। অতিরিক্ত জল উত্তোলনের ফলেই পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ সহ বিস্তীর্ন এলাকাতে আর্সেনিক দূষণ ভয়াবহ আকার নিয়েছে, তাছাড়া উপরিভাগে প্রচুর দূষিত বর্জ্য পদার্থ মাটির অভ্যন্তরের জলস্তরকেও বিষাক্ত করে তোলে।

       অতিরিক্ত জল উত্তোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে আইন প্রণয়ন করা হলেও তার কার্যকারিতা প্রায় শূন্য। ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন শহর থেকে গ্রামে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যার ফলে সামগ্রিক চাষবাস, কলকারখানার কাজ ছাড়াও ঘরের সাধারণ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের আকাল দেখা দিচ্ছে অনেক জায়গাতেই। বার বার সাবধানতার বার্তা ঘোষিত হওয়া সত্বেও কেউ কোনোরকম দায়িত্বের পরিচয় দেয়নি এক্ষেত্রে। যার ফলে ভূগর্ভস্থ নির্মল জলের অফুরন্ত ভান্ডার আজ চরম দুর্দিনের মুখোমুখি। শুধু আজকের সমস্যা নয় এটা, বহুদিন থেকেই বিজ্ঞজনেরা ভবিষৎবাণী করে আসছিলেন যাতে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন না হতে হয়। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ গঙ্গার জলকে সংরক্ষণ করার জন্য যথেষ্ট শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহা বলেছিলেন, ভারতের নদীগুলির স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রচুর সভা, আলোচনা হয়েছে ঠিকই কিন্তু আর যাই হোক, বাসবসম্মত সমাধান যে হয়নি, তা বলাই বাহুল্য।

      আসলে সত্যি কথা বলতে, যে সংকটের সম্মুখীন আমরা হয়েছি, তার সমাধান এই মুহূর্তে শুধুমাত্র সরকার পক্ষ থেকে হওয়া সম্ভব নয়। এই সত্য দেশের সরকার ভালোভাবেই বুঝে গেছে এবং সেই উপলব্ধি থেকেই প্রধানমন্ত্রী সংকটের মোকাবিলা করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে বলেছেন। সাধারণ মানুষ এগিয়ে এলে যে অনেক দুরূহ সমস্যাও মোকাবিলা করা সম্ভব, তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, আমাদের রাজ্যে একসময় যথেষ্ট রক্ত সংকট ছিল, শুধুমাত্র সরকারি তরফে রক্তদান শিবির করে সেই সমস্যার সমাধান কিছুতেই করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু যত দিন গেছে, ততই বেসরকারি সংস্থা, অফিস, ক্লাব, গ্রন্থাগার, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র সংগঠন, বাজার সমিতি প্রভৃতি সমস্ত রকম দিক থেকে এগিয়ে এসেছে সকলেই, ফলে এখন সেই সংকটের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। তাই জল সংরক্ষণ সহ কৃষিক্ষেত্রে চিরাচরিত পদ্ধতিগুলির পুনরায় প্রয়োগের মাধ্যমে অনেকটাই জল সমস্যা মেটানো সম্ভব বলে বিজ্ঞমহল মনে করছেন।

    উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুজরাটের দাহোদ ও বাঁশোয়ারা জেলার মানুষেরা একসময় তীব্র জলাভাব ভোগ করেছেন। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় পদ্ধতির সাহায্যেই ওই এলাকার মানুষেরা নিজেদের পায়ের তলার মাটি ফিরে পেয়েছেন। ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট-এর মাধ্যমে কমিউনিটি লিফ্ট ইরিগেশন স্কিম করে প্রায় ৬০ কিমি এলাকার ৫২ হাজার ৩৪৪ একর কৃষিজমি এবং প্রায় ২৭ হাজার ২০০ গৃহস্থের বাড়ির জলাভাব মেটানো সম্ভব হয়েছে। ওই সংস্থা কিন্তু পদ্ধতিটি চালু করার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকুই করে দিয়েছিল, বাকি তারা নিজেদের গরজেই নিজেদের উন্নয়নে শরিক হয়েছে।

     পশ্চিমঘাট পর্বতমালায়, মহারাষ্ট্রের পঞ্চগনিতে প্রচুর প্রস্রবণ ছিল। বহু প্রস্রবণ-ই পরিবেশের কারনে আজ ধ্বংসপ্রায়। স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা পাহাড়ের মৃত প্রস্রবণগুলি পুনরুজ্জীবনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলল। পাহাড়ের ওপর এমন জায়গায় বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হল, যেখান থেকে তা অনায়াসে কোনো না কোনো প্রস্রবনের মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। এই চেষ্টা কিন্তু সফল হয়েছে। আসার কথা, মজে যাওয়া নদী এবং পরিত্যক্ত নদীখাত কেটে তাতে কাছাকাছির নদী বা জলাধার থেকে জল বইয়ে খরার মোকাবিলা করার কথা অনেকেই ভাবছেন। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারও এই পদ্ধতিটি নিয়ে ভাবছেন।

     পশ্চিমবঙ্গেও 'জল ধরো, জল ভরো' শ্লোগানকে সামনে রেখে বড় বড় জলাশয় কাটার কাজ করা হচ্ছে সরকারি তরফে। বড় বাঁধের গুরুত্ব যেভাবে প্রচার হয়ে থাকে, তা যে বাস্তবে খুব একটা কাজে দেয়না, সেটা এখন ভালোই বোঝা যাচ্ছে। মেধা পাটকররা যে দেশের শত্রু নয়, তা অনেকেই বুঝতে পারছেন। সরাসরি প্রায় ৫০ কোটি মানুষের জীবন জীবিকা এই মুহূর্তে সংকটে। এই মুহূর্তে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে তর্ক করা বা সরকারকে দায়ী করার থেকেও বড় কাজ জলধারণ, সংরক্ষণ এবং সরবরাহ করার দেশজ পদ্ধতিগুলো পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সাধারণ মানুষের উদ্যোগী হওয়া। সকলে মিলে একযোগে কাজ করলেই সমস্যা থেকে আমরা পরিত্রাণ পাবো তা বলাই যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...