মোহন সুরের হরিপ্রসাদ

খানদানের ইতিহাসে সুরের নামগন্ধ ছিল না কোনওদিন। বংশের কেউ কখনও রেওয়াজ তালিম এই শব্দগুলোর ধারকাছ দিয়েও যায় না। বাবার কাছে গুরুবাড়ি বলতে আখড়া। সেই বাড়ির সন্তান, তিনিই কিনা হয়ে উঠলেন এ দেশের মোহন বাঁশির আহির ভৈরব।

কোনও এক ভোরে ঈশ্বর যেন তাঁর হাতেই যেন তুলে দিয়েছিলেন আপন বাঁশিখানা। শিব ঠাকুরের আপন ভূমি কাল পেরিয়ে সেই বাঁশিকেই চিনেছিল চৌরাশিয়ার বাঁশি বলে। হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া।
কথাই ছিল না বাঁশুরিয়া হওয়ার।

বাবা ছিলেন তেজি পালোয়ান। চাইতেন ছেলেও আখড়ায় আসুক। ধরে বেঁধে, জোর করে হলেও। এদিকে ছেলে বাবাকে দেখলেই উল্টো দরজা দিয়ে পালায়। তাকে আখড়ার ধস্তাধস্তি টানে না। তার মন ডুবে থাকে সুরে।
পাড়াতেই জীবনের প্রথম গান শিখতে যাওয়া। এক প্রতিবেশীর কাছে।

HariprasadChaurasia1

ছেলে সুর চাইলে হবে কী, সুরের চলন যে তার গলায় বসে না। শিক্ষক তাই পরামর্শ দিলেন যন্ত্রের মধ্যে সুর খুঁজে নিতে।
দামে কম। লুকতে সুবিধে। হাতে করেই দিব্যি ধরা যায়। হরিপ্রসাদ তাই বাঁশিকেই সঙ্গী করলেন। বদলে গেল শিক্ষকও।
চলল অনুশীলন। তবে জীবনের আসল দরজাটা খুলে গেল অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে গিয়ে। তাঁর কথায় " মা জীবন্ত ঈশ্বরী"।


আকন্ঠ সাধনায় ডুবিয়ে দিলেন নিজেকে। গুরুর পথই তাঁর পথ। যেদিকে চালাবেন তিনি তেমনই চলবেন। দিন থেকে রাত শুধু তন্ময় সাধনা। যেন দ্বিতীয় জন্ম পেলেন তিনি অন্নপূর্ণা স্পর্শে। তাঁর কথায়, " ম্যায়নে কেয়া কইয়া, উনহনে করবাওয়া।" নিজেকে বলেন, আমি শুধু মাধ্যম। যা যাদু সব গুরুই করেন।
কেরিয়ার শুরু অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো'তে।
পরবর্তী সময়ে জুটি বাঁধেন শিবকুমার শর্মার সঙ্গে। তিনি এলাহাবাদ আর শিব জম্মুর। দেখা হল বোম্বাইতে। মিলে যেতেই বন্ধু। তাঁদের জুটিকে বলা হত 'শিব-হরি'।

দুই বন্ধুর মন কষাকষি হয়েছে। ঝগড়াও হয়েছে, কিন্তু সবটাই বন্ধুসুলভ। দুজনেই দুজনকে ছাড়া ভাবতে পারেন না।
পন্ডিত রবিশঙ্কর যেমন জুড়ে ছিলেন বিটলস দলের সঙ্গে তেমনভাবেই জুড়েছিলেন হরিপ্রসাদও। লাইট আর ওয়ান্ডারওয়াল বিটলসদের এই দুই গানে সঙ্গত করেছিলেন তিনি।

HariprasadChaurasia2

জীবনে বহু সম্মান, পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু সুর ছাড়া কোনও কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে ন। প্রবীণ শিল্পী বলেন, আমি যে সত্যিটা জানি, " কি খালি হাত আয়ে থে, খালি হাত জানা হ্যায়"। এমনকি যে সঙ্গীতের জন্য প্রাণটাও নিবেদন করা আছে তাকেও নিয়ে যেতে পারব না সঙ্গে...

দু'দুটি গুরুকুল আছে তাঁর। ওড়িশা আর বোম্বাই।
ছাত্রছাত্রীদের বলেন, "সুরে সুরে ডুবে যাও খালি। সুর প্রার্থনা করতে হয় ঈশ্বরের কাছে। শুধু জ্ঞানের জন্য না, একজন আদর্শ সঙ্গীত সাধকের পথ এভাবেই তৈরি হয়।"
সদ্য ৮৩-তে পা দিলেন। আহির ভোর থেকে মধ্য যাম- হরিপ্রসাদের বাঁশি আজও অকাতর। আগলে রাখে সুর-কাঙালের দিনরাত...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...