অমলা নন্দী। তখনও তিনি ‘শঙ্কর’-এর ছত্রছায়ায় আসেননি। বাবা অক্ষয় কুমার নন্দীর সঙ্গে প্যারিসে থাকাকালীন কলোনিয়াল একজিবিশনেই প্রথম দেখা উদয় শঙ্করের সঙ্গে। তখন বয়স মাত্র এগারো। উদয়ের আমন্ত্রণেই তাঁর ‘ডান্স ট্রুপ’-এ যোগ দেন অমলা। কষ্টি পাথরে ধরা পড়ে খাঁটি রত্ন। উদয়ের কাছেও ধরা পড়েছিলেন তাঁর জীবন-সাধনা সঙ্গিনী অমলা।
উদয় শঙ্করের নৃত্য-নির্দেশনায় অংশগ্রহণ করে ইউরোপের একাধিক মঞ্চে যশস্বী হয়ে ওঠেন অমলা। দীর্ঘ এক বছর ইউরোপ সফর শেষে অমলা শঙ্কর কলকাতা ফিরে নৃত্য চর্চায় নিমগ্ন হন। এ সময় তিনি উদয় শঙ্কর ও কথাকলির নৃত্যগুরু শঙ্করণ নামবুদ্রির কাছে নৃত্যের তালিম নিতে থাকেন। পরবর্তীতে আলমোড়ায় ইন্ডিয়ান কালচার সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হলে অমলা এখানে এসে যোগ দেন। এখানে তাঁর নৃত্য চর্চার সাথে সাথে চলতে থাকে চিত্র কলার চর্চাও।
সারা বিশ্বজুড়ে তখন পারফর্ম করে বেড়াচ্ছেন উদয়-অমলা। এসবের মধ্যেই উদয়-অমলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তাঁরা আজীবন একসঙ্গে কাটাবেন। ১৯৩৯ সালে তিনি যখন ডান্স ট্রুপের সঙ্গে চেন্নাইয়ে রয়েছেন, তখনই অমলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসে। ১৯৪২ সালে উদয় শঙ্কর বিয়ে করেন অমলাকে। অমলা ‘নন্দী’ সারা বিশ্বে খ্যাত হয়ে ওঠেন অমলা ‘শঙ্কর’ হিসেবে।
নৃত্যশিল্পী অমলা শঙ্করের আর একটি বিশেষ শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর চিত্রকলার মাধ্যমে। বিশেষ করে কলকাতা ইডেন গার্ডেনের উন্মুক্ত মঞ্চে উদয় শঙ্করের ‘লর্ডবুদ্ধ’ রঙ্গিন ছায়ানৃত্যে তাঁর আঁকা সুন্দর সুন্দর স্লাইডগুলো দর্শকদের আকৃষ্ট করে এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ নৃত্যনাট্যেও তাঁর আঁকা স্লাইডগুলোও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। অমলা শঙ্কর সারা জীবন সাধনা করে ‘উদয় শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচার সেন্টার’- এ নৃত্য পরিচালনার মাধ্যমে নৃত্যকলার প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বাংলার ‘ক্রিয়েটিভ কালচার-ট্রাডিশন’-কে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দেওয়ায় তার অবদান সদা উল্লেখযোগ্য।
১৯৯১ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে দেশের অন্যতম উচ্চ সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পান। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমন তাঁর হাতে এই সম্মান তুলে দিয়েছিলেন।
উদয়-অমলা’র যাবতীয় নৃত্যানুষ্ঠা্নের অসাধারণ নৃত্য-কলাকৌশল যে সৌন্দর্যময় স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি করতো, তা সে প্রজন্মের দর্শকের হৃদয়ে আজও অম্লান হয়ে আছে। আর এ প্রজন্মে তাঁদের ‘লেগাসি’ বহন করে নিয়ে চলেছেন তাঁদের পুত্রবধূ তনুশ্রী শঙ্কর এবং কন্যা মমতা শঙ্কর। তাঁদের পুত্র আনন্দ শঙ্কর ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর সেতারের সুর বিশ্বনন্দিত। ২৭ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘লিভিং লেজেন্ড’ অমলা শঙ্কর। এ বছরই শতবর্ষ পূর্তি হল তাঁর।
অমলা শঙ্করের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে কসবায় উদয়ন কলাকেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট প্রাঙ্গনে ২৭ জুন প্রকাশিত হতে চলেছে অমলা শঙ্করের একটি স্মৃতিকথা, ‘শঙ্করনামা’। এছাড়া, আগামী ২৮ জুন রবীন্দ্র সদনে তনুশ্রী শঙ্করের তত্ত্বাবধানে পারফর্ম করবে ‘আনন্দ শঙ্কর সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস’। ২৯ তারিখে রয়েছে মমতা শঙ্কর ডান্স কোম্পানি-র নৃত্যানুষ্ঠান। এছাড়াও দেখা যাবে দিল্লির ‘সধ্যা পারফর্মিং ট্রুপ’এর নৃত্য প্রদর্শন।