কুরকুট খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্ত করছেন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর তথা জঙ্গলমহলের মানুষ। এই কুরকুট হল এক ধরণের পিঁপড়ের ডিম। সাঁওতালি ভাষায় ওরা ডাকে 'হাও' বা 'হাউ' নামে। কমলা রঙের এই পিঁপড়ে লক্ষ্য করা যায় বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, সমস্ত ঝাড়খন্ড এবং ওড়িশার জঙ্গলেও। এই পিঁপড়েরা স্বভাবে বেশ সতর্ক এবং দ্রুতগামী। বিপদ বুঝলে আক্রমণকারীকে জবাবে পাল্টা ধাওয়া করতে আসে। ক্ষিপ্র গতিতে বড় বড় বৃক্ষের ওপর থেকে নিচে যাওয়া আসা করতে পারে এই পিঁপড়েরা। বড় গাছের মগ ডালে পাতার সাথে পাতার নিপুণ সেলাই করে ঘর বেঁধে বসবাস করে এরা।
'উইভার এন্ট' নামেও পরিচিত এই পিঁপড়ের দল। মগডালে বাসা বাঁধতে এদের লার্ভা থেকে নিঃসৃত হয় এক প্রকার সিল্ক, তা দিয়েই তিন চারটে পাতাকে মুড়ে একটি থলির আকারে সেলাই করে ঘর বানিয়ে নেয় এরা। এই থলি দেখতে যেমন সুন্দর আর মজবুতও হয় তেমনি। এদের খাবার হল পাকা ফল এছাড়াও উইপোকা এবং ওই জাতীয় কীট পতঙ্গ থেকেও খাবার রস সংগ্রহ করে এরা। পিঁপড়ের বাসাতে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে রাখে 'ইকোফাইলা' রা। এই পিঁপড়েদের ভিতর রয়েছে দুই ধরনের শ্রম বিভাজন। একদল পিঁপড়ের সুদক্ষ কাজের মাধ্যমে এরা খাদ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি বসতি বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা রাখে, সৈনিক 'ইকোফাইলার' বলা হয় এদের। আর একদল পিঁপড়ে যারা বাসা তৈরী করে,খাদ্য সংগ্রহ করে, রানী ও লার্ভার দেখভাল করে তাদের বলা হয় শ্রমিক 'ইকোফাইলা'। পিঁপড়ে দলের রানী বাসার ভিতরেই অবস্থান করে অন্যান্য পিঁপড়ে দলের মতোই।
শীত-বর্ষার আগে আগে গাছের উঁচু ডালে সাদা চালের মত দেখতে অগণিত ডিম পেড়ে রাখে পিঁপড়েরা। এই পিঁপড়ের ডিমের চাটনি বা কুরকুটের চাটনি অত্যন্ত জনপ্রিয় বাঁকুড়া -পুরুলিয়া এলাকায়। কুরকুট-এর চাটনি তৈরির নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। চার চামচ কুরকুটের সাথে কাঁচা লঙ্কা, পুদিনা পাতা, অল্প পিয়াজ, রসুন টুকরো বেটে কাঁচা সরিষার তেল আর প্রয়োজন মতো নুনের সাথে মিশিয়ে তৈরী হয় কুরকুটের চাটনি। এই চাটনি অনেকে শাল পাতায় মুড়িয়ে আগুনে ঝলসে খেতে ভালোবাসেন। অনেকে এই ঝলসে খাওয়ার ধরণকেই বেশি সুস্বাদু বলেন আবার অনেকে এই মিশ্রনের সাথে একটু সরষে বেটে খেতে পছন্দ করেন।
খাদ্য গুনের পাশাপাশি কুরকুটের রয়েছে ওষধি গুণ। ভিটামিন সি তে ভরপুর কুরকুট আছে, সাথে রয়েছে ক্যালসিয়াম। সাধারণ সর্দি কাশি এবং শিশুদের কাশিতে খুব উপাদেয় এই দুটি উপাদান। শীতকালে শীতের মোকাবিলায় কুরকুটের ঝোল বিশেষ সহায়ক বলে বিশ্বাস করে শবর জনগোষ্ঠীর লোকেরা। প্রকৃতির একদম কাছাকাছি যাদের বেড়ে ওঠা প্রকৃতিই তাদের টিকে থাকার রসদ জোগায়। কুরকুট এমনি একধরণের ট্রাইবাল মেডিসিন। আয়ুর্বেদিক সহ নানা এলোপ্যাথি ঔষধের উপাদান হিসেবেও ব্যাবহৃত হয় অরণ্যের নানা উপাদান। অরণ্যবাসী বা সংশ্লিষ্ট বসবাসকারীরা বনের পথে পথে এই সব সংগ্রহ করে বিক্রি করে হাট বাজারে। শীতকালে জঙ্গলমহলে প্রতিটি হাটেই বিক্রি হয় কুরকুট। গ্রাম থেকে গ্রাম ফেরি করেও বিক্রি করে অনেকে। স্থানীয়দের কাছে চাল ডাল অন্যান্য নিয়মিত আনাজের সাথে খুব একটা পার্থ্যক্য নেই কুরকুটের। পছন্দের আরেকটি খাবার হিসেবেই তারা কিনে নেন এই খাবারটি।
কুরকুট ব্যবহার করা যায় তিনটি উপায়ে - খাবারের পাশাপাশি ভেষজ ঔষধ এবং মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় কুরকুট। মাছ ধরার সময় টপ তৈরী করা যায় কুরকুট দিয়ে। স্থানীয় বাজারে কুরকুট বিক্রি হয় কেজি প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে। কিন্তু ফড়েদের হাত ঘুরে দুর্গাপুর, আসানসোল, বারাসাত, দমদম এলাকায় আড়তে রেখে দেওয়া কুরকুটের মূল্য দাঁড়ায় কেজি প্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা চায় প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে এই বহুমুখী সুবিধাজনক 'কুরকুট' কে সরাসরি আর্থিক স্রোতে এক করতে। সুনির্দিষ্ট উদ্যোগে 'কুরকুট' এর বাজার একদিন স্বীকৃত সামগ্রী হিসেবে উঠে আসবে এমনটাই আশা জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের।