নীরা: আত্মরতি পেরিয়ে সুনীলের আত্মদর্শনের আয়না

কাপড় কাচা সাবানের গন্ধমাখা কালো ছোপধরা চায়ের কাপে উদ্ভ্রান্তের মতো শেষ চুমুকটি দিয়ে সুনীল টিউশ্যুনি সময়ের আগে ছুটি দিয়ে দিলেন। উদভ্রান্তের মতোই পড়াতে এসেছিলেন, বিভ্রান্তের মতো বেরিয়ে এলেন। এলোমেলো হাঁটতে লাগলেন রাস্তায়। 



তাঁর 'অপর্ণা' আজ তাঁকে চিনতে পেরেছে। এতদিন পর। বাউণ্ডুলে বলে, বেকার বলে। তাই অবলীলায় বলে দিতে পেরেছে সম্পর্কটা কন্টিনিউ করা আর তার পক্ষে সম্ভব নয়! আর এই চরম কথাটা বলে দিতেই, সুনীল দেখলেন, এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা, স্বপ্ন-সব-শুধু একটা ‘সম্পর্ক’মাত্র হয়ে গেল!



রাস্তায় কীসের যেন ধর্মঘট। মিছিল। পুলিশের ব্যারিকেড। লাঠিপেটাই চলছে। ঘোরের মধ্যে সেখানেই এসে পড়লেন সুনীল। মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে উঠল। সব যেন গুলিয়ে গেল!

SunilGangopadhyay2

সেই অকুস্থলে পড়ে পিঠটান দিয়ে সবাই তো পালিয়ে বাঁচে, সেই পালাবার ক্ষমতাটুকুও আর রইল না! ধেয়ে এল পুলিশের দুর্বিনীত লাঠি, তখনই কে যেন হাত ধরল এসে। একটি নারী, টেনে এনে শক্ত হাতে দাঁড় করিয়ে দিল আশ্বাসের মাঠে। ওরই নাম বুঝি, 'নীরা'। তাহলে নারীই ব্যথা দেয়, দেয় উপশমের ঔষধ! সুনীল বললেন, ‘নীরা, ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না...’



আর তক্ষুনি নীরা আরও শক্ত করে ধরল সুনীলের হাত। আসলে নীরার জন্যই কলকাতা শহরের পথ বেয়ে নদী বয়ে যায়, রৌদ্র স্নান করে জ্যোৎস্নায়। জীবনানন্দের বনলতা সেন, বুদ্ধদেব বসুর কঙ্কাবতীর আলো পেরিয়েও নীরা এমন এক পার্থিব মানুষী, যাকে পেয়ে সুনীল বলে ওঠেন, ‘নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী।’ 



শীত শেষের এক দুপুরে হঠাৎ নীরাকে আমন্ত্রণ জানান সুনীল। বলেন, আজ বাড়িতে সাদা থিকথিকে মাছ, ঐ যে গো, যাকে লইট্যা মাছ বলে, পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা বেগুন দিয়ে আচ্ছাসে রেঁধেছি। বাড়ির কেউ সে-মাছ খায় না। এস না নীরা, আমি আর তুমি দুজনে মিলে খাই আর কাটিয়ে যাই অর্ধেক জীবন... 



লোকে 'তারুণ্য তারুণ্য' বলে হ্যাংলায় বটে, কিন্তু আমি তো জানি দিনগুণতির তারুণ্য দিয়ে কিস্যু হয় না...ঐ তো ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’ চল্লিশের চালশে পেরিয়েই তো লেখা...তারুণ্যের আর কী দিয়েই বা বুক বাজাব আমি? তোমায় ছাড়া?

SunilGangopadhyay1

নীরাকে পেয়ে সুনীলের আত্মকথা শেষ হয় না, শেষ হয় না আত্মার কথা:



আমার তখন বছর চার কয়েক মাস বয়স, জানো তো! বাবা ইস্কুলে পড়ান। আমিও ইস্কুলে যাই। দু’নম্বর বিশ্বযুদ্ধে বাংলায় ঘিরেছে আকাল। নুন দিয়ে আলুপোড়া খেতে খেতে পড়ে ফেলি পোড়া বাংলার সুবোধ বালক হওয়ার পাঠ, 'বর্ণপরিচয়'। ফরিদপুর আর কলকাতার সাঁকো বড় দীর্ঘ, বড্ড নড়বড়ে। সাঁকো পেরিয়ে চলে এলাম এপারে। বিদেশ হয়ে গেল জন্মভূমি। সাঁকোটা ভেঙে গেল!



পেলাম কলকাতার পিচ ঢালা রাস্তা। সেই রাস্তা দিল টেনিসনের ট্রান্সলেশন, শক্তির সাহচর্য, সখ্য, শরৎকে দিল, ফণীভূষণ আচার্যকে দিল, আর দিল ‘কৃত্তিবাস’ এর আখড়া। গড়ে উঠল আর-এক সাঁকো। 



তারপর প্রথম স্বীকৃতিটা বুদ্ধদেব বসুই দিলেন। দিলেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ বইতে। আধুনিক কবিদের কবিতা সংকলনের শেষ সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি ভূমিকায় ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত’ লিখে দিলেন। তখন কী যে আনন্দ হল! আমিও তাহলে মাইলস্টোনের প্রত্যয়ে পংক্তিগত হলাম! 



নীরার কাছে প্রগলভ হতে বাধা নেই, তবু একসময় অর্ধেক জীবনী শেষ হয়...

 

বুদ্ধদেব বসু সত্যিকারের জহুরী ছিলেন, সুনীলের কৃতিত্বকে তিনিই সেই সময় প্রকৃত অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেই কৃতিত্বে তিনি সত্যিই মাইলস্টোন। আধুনিক কবিতায় অত্যন্ত সাদামাঠা মুখের কথা, চকিত মনের ভাবনাকে সহজ দ্যুতিতে কবিতায় তুলে আনার কৃতিত্ব সুনীলের। তাই মনখারাপ নিয়েও তিনি অনায়াসে অসাধারণ কাব্য করতে পারেন-

‘মন ভালো নেই   মন ভালো নেই   মন ভালো নেই

বিকেল বেলায়   একলা একলা    পথে ঘুরে ঘুরে

কিছুই খুঁজি না   কোথাও যাই না   কারুকে চাইনি...’।



কবিতাটার নামই ‘মন ভালো নেই’। কাব্যের নামও তাই। মানুষের মন খারাপ হলে সে যে কী করবে আর কী করবে না, ভেবে পায় না। কী করলে মন খারাপ কাটবে বুঝতে পারে না। সেই এলোমেলো অভিব্যক্তি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।

SunilGangopadhyay

কলকাতার এলোমেলো পথ তাঁকে অনেক দিয়েছে। এই পথেই একদিন অ্যালেন গিনসবার্গ এসে পাঠ পড়িয়ে দিয়ে গেলেন আত্মরতির। 



সেই আত্মরতির সম্মোহন পেরিয়ে সুনীলকে নীরার সামনে বার বার দাঁড়াতে হয়, নিজেকে খুঁজতে:



আমি সুনীল, মনে ও শরীরে শান্তি চেয়েছি শুদ্ধতা চেয়েছি, সে তো তুমিই দিয়েছ নীরা, তুমি ছাড়া আর কেই বা আছে আমার, ‘বাহান্ন তীর্থের মত তোমার ও-শরীর ভ্রমণে পুণ্যবান হবো।’ 



'অর্ধেক জীবন' পেরিয়ে পূর্ণ জীবন শেষ করেও কবিদের মৃত্যু হয় না কোনদিন। তাঁর পথ পরিক্রমা চলতে থাকে, বাঁকা গলির বাঁকে বাঁকে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন, অন্ধগলির শেষে তিনিই হন আলোকবর্তিকা। আর সর্বত্রই আমরা তাঁর সঙ্গে যুগলে পাই কাঙ্ক্ষিত নীরাকে...



ঋণ: 'অর্ধেক জীবন'- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, কাব্যগ্রন্থাবলী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...