সতীপীঠঃ শ্রীলঙ্কায় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র দেবীমা ‘ইন্দ্রাক্ষী’র মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করেছিলেন

ত্রেতা যুগে ‘শ্রীলঙ্কা’ যখন শুধুই ‘লঙ্কা’ নামে পরিকীর্তিত হত, তখনই সে স্বর্ণময় ঐশ্বর্য ও ছন্নমতী রাজা রাবণের কাহিনি নিয়ে আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর গাথার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে জনমানসে সুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। মানুষ জেনেছিল যে এই ভূমি একইসঙ্গে দেবভূমি, বীরভূমি এবং বিভীষণের মতো ন্যায়পরায়ণ সন্তানের জন্মভূমি। শুধু ‘রামায়ণ’ নয়, লঙ্কা দেশের কথা উঠে এসেছে আমাদের পৌরাণিক কাহিনিতে শক্তি-উপাসনার সূত্র ধরেও। তাছাড়া শাক্ততন্ত্রগ্রন্থগুলিতে গৌরবের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, এই ভূমি শুধুই সাধারণ শক্তি-উপাসনাক্ষেত্র নয়, এখানে রয়েছে একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠও। তন্ত্রগ্রন্থের একটি শ্লোকে বলা হয়েছেঃ

‘লঙ্কায়াং নূপুরশ্চৈব ভৈরবো রাক্ষসেশ্বরঃ

ইন্দ্রাক্ষী দেবতা তত্র ইন্দ্রোণোপাসিতা পুরা।।’

শ্লোকটির অর্থঃ লঙ্কাদেশে দেবী সতীর নুপূর পতিত হয়েছিল। এখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম, ‘ইন্দ্রাক্ষী’ এবং দেবীর ভৈরব মহাদেবের নাম, ‘রাক্ষসেশ্বর’। দেবী পুরাকালে দেবরাজ ইন্দ্রের উপাসিতা ছিলেন। অর্থাৎ, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এই ভূমিতে দেবীর কোন দেহাংশ পতিত হয়নি, পতিত হয়েছিল দেবীর অলঙ্কার। তা থেকেই পীঠের উদ্ভব। এবার এই শ্লোক থেকে দুটি প্রশ্ন উঠে আসেঃ প্রথম প্রশ্ন, লঙ্কা বা শ্রীলঙ্কা কোন ছোট্ট স্থান নয়, শ্লোকটিতে দেবীর পীঠস্থান এই দেশের কোথায় অবস্থিত, তা নির্দিষ্ট করে বলা নেই। সেই পীঠস্থানটি ঠিক কোথায়? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই পীঠস্থানের দেবীর সঙ্গে ইন্দ্রের উপাসনার যোগ কোথায়?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, দেবী ইন্দ্রাক্ষীর পীঠস্থানটি শ্রীলঙ্কার জাফনার নাইনাতিভু দ্বীপে অবস্থিত। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর একটি পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে রয়েছে। কাহিনিটি হলঃ

ঋষি গৌতমের পত্নী অহল্যা ছিলেন যেমন রূপবতী, তেমনি সতী-সাধ্বী। একবার অহল্যার রূপ দেখে দেবরাজ ইন্দ্র দারুণ মোহিত হলেন, মনে জাগল ভোগ করার উদগ্র বাসনা। পৌরাণিক কাহিনিতে দেখা যায় যে, সে-কালে প্রার্থনা করলে অনেকেই স্বেচ্ছায় দেহদান করে কামার্তের ইচ্ছা পূরণ করতেন। ব্যাসদেব বা বিদুরের জন্মবৃত্তান্তে তার বিবরণ আছে। কিন্তু অহল্যা সতীত্ব নিয়ে এতটাই কঠোর যে, কোনভাবেই অতিথিরূপে বাসনা নিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে দেহ প্রার্থনা করলে তিনি দেহদান করবেন না। তাই ইন্দ্র ছলনার আশ্রয় নিলেন। 

পত্নীকে নিয়ে গৌতম তপোবনে কুটির নির্মাণ করে বাস করতেন। দেবরাজ নিজের কামনা কিছুতেই সংবরণ করতে না-পেরে সেদিন মধ্যরাতেই প্রকৃতির মধ্যে মায়া বিস্তার করে মিথ্যা প্রভাতের ছলনা করলেন। প্রভাত হয়েছে ভেবে গৌতম অহল্যাকে শয্যায় রেখে প্রাতঃকৃত্যের জন্য কুটির থেকে নির্গত হলেন। সেই অবসরে ইন্দ্র গৌতমের ছদ্মবেশ ধারণ করে কুটিরে প্রবেশ করে শয্যা গ্রহণ করলেন এবং অহল্যার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হলেন। নিখুঁত ছদ্মবেশের জন্য অহল্যা ইন্দ্রের ধোঁকা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না।

ওদিকে আসল ঋষি গৌতম বাইরে বেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে বুঝতে পারলেন যে, এখনও রাত্রি প্রভাত হয়নি। তাঁর কোনভাবে প্রভাতের বিভ্রম হয়েছিলমাত্র। তাই গৌতম কুটিরে ফিরে এলেন। ফিরে এসেই তাঁর চক্ষুস্থির। দেখলেন তাঁরই ছদ্মবেশে ইন্দ্র ও অহল্যা সঙ্গমে লিপ্ত। এই ছলনায় নিদারুণ ক্রোধ হল তাঁর। বেরিয়ে এল কঠোর অভিশাপ। তিনি অহল্যাকে অভিশাপ দিলেন কঠিন পাথরে রূপান্তরিত হওয়ার। আর ইন্দ্রের অন্যায় কামনার জন্য তাঁকে অসীম কামনার জ্বালায় জ্বলবার অভিশাপ দিলেন। এতে ইন্দ্রের দেহে সহস্র যোনি উদ্গত হল। তখন অসহ্য কামনায় কাতর হয়ে তিনি গৌতমের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে মুক্তির নিদান চাইলেন। অনেক অনুনয়ে গৌতম কিছুটা শান্ত হয়ে বলে দিলেন মুক্তির উপায়। বললেন, কোনো শক্তিপীঠে গিয়ে দীর্ঘকাল দেবী শক্তির আরাধনা করলে এবং তাতে দেবী তুষ্ট হলে তবেই ইন্দ্রের শাপমুক্তি ঘটবে।

ব্যস, উদ্ধারের উপায় পেয়ে ইন্দ্র বেছে নিলেন লঙ্কা দেশের নির্জন এক দ্বীপ। মণিদ্বীপ। এই দ্বীপের বর্তমান নাম, নাইনাতিভু। এই স্থানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর নূপুর পতিত হয়েছিল। হয়ে উঠেছিল এক গুপ্ত অথচ জাগ্রত শক্তিপীঠ। এই পীঠ অপেক্ষা করছিল প্রকৃত ভক্তের উপাসনার জন্য। মাহাত্ম্যগাথা বিস্তারের জন্য। এখানে এসেই ইন্দ্র দেবীর মূর্তি নির্মাণ করে শুরু করলেন দেবীর কঠোর ও ঐকান্তিক আরাধনা। বছরের পর বছর চলল সাধনা। একদিন তাঁর সেই সাধনায় দেবী তুষ্ট হলেন। তখন দেবী ইন্দ্রকে কৃপা করলেন। দেবীর কৃপায় ইন্দ্রের দেহের সহস্র যোনি সহস্র চক্ষুতে পরিণত হল। তখন ইন্দ্রের এক নাম হল, ‘সহস্রাক্ষ’। অন্যদিকে এই দেবীর কৃপায় যেহেতু ইন্দ্রের শাপমুক্তি ঘটে অক্ষি প্রাপ্তি ঘটল, তাই দেবীরও নাম হল, ‘ইন্দ্রাক্ষী’।

যাই হোক, দেবীর কৃপায় ইন্দ্র মুক্তি পেয়ে মানবের হাতে দেবীর পূজার ভার দিয়ে শুদ্ধ হয়ে পুনরায় স্বর্গে গিয়েছিলেন। এই কাহিনি থেকেই ভক্তদের বিশ্বাস যে, এই পীঠে অধিষ্ঠিত মূর্তি স্বয়ং ইন্দ্রের হাতে নির্মিত।

দেবীর পৌরাণিক নাম ‘ইন্দ্রাক্ষী’ হলেও স্থানীয় সিংহলী-সাধারণের কাছে তিনি ‘নাগপুশানি আম্মান’ নামে পরিচিতা। দেবীর এমন নামের পেছনেও রয়েছে পুরাণ-ঘেঁষা কিংবদন্তি। সেটি হল এরকমঃ

আমরা জানি যে, সাপ ও গরুড়ের শত্রুতা সেই সমুদ্র-মন্থনের পৌরাণিককাল থেকেই চলে আসছে। তো, সেই সময় একদা একটি বিশাল সাপ দেবীর উপাসনার জন্য সমুদ্র পেরিয়ে মণিদ্বীপে যাচ্ছিল, কিন্তু পথে গরুড় তার পথ আটকায়। গরুড় এসে বসে দ্বীপের উপকূলের একটি পাথরে। সাপটি গরুড়ের নিকটের একটি পাথরে এসে অনেক অনুনয় করতে লাগল তাকে হত্যা না-করার জন্য ও দেবীর কাছে যেতে দেবার জন্য। গরুড়কে খুশি করার জন্য নিজের ওপর আঘাতও করতে শুরু করল সে। কিন্তু তাতেও গরুড়ের মন গলল না।

এই পুরো ব্যাপারটা দেখল একজন বণিক। সে এই পথ দিয়েই বাণিজ্যে যাচ্ছিল। সাপের অমন কাতর প্রার্থনায় তার মনে খুব মায়া হল। সেও গরুড়ের কাছে সাপের হয়ে প্রার্থনা শুরু করল। তখন গরুড় তাদের কাছে শর্ত রাখল যে, বণিক যদি দেবীমায়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেয়, দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করে এবং সাপ যদি দেবীমায়ের অঙ্গের অলঙ্কার হয়ে থাকে, তাহলে সে সাপকে ছেড়ে দেবে। গরুড়ের প্রস্তাবে সাপ ও বণিক দুজনেই রাজি হল সানন্দে। তারপর বণিক অল্পদিনেই গড়ে তুলল দেবীর মন্দির, বাণিজ্যে যেখানেই যেতে লাগল দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করতে শুরু করল। তার এই প্রচারে অচিরেই দেশবিদেশের অগণিত ভক্তজন শুরু করল দেবীর মন্দিরের পূজার জন্য আসতে। আর সাপ, সেও দেবীর অঙ্গে অলঙ্কার হিসেবে সুশোভিত হতে লাগল। এখান থেকেই দেবীর নাম হল, ‘নাগপুশানি আম্মান’। এর মানে, যে মায়ের অঙ্গে রয়েছে সাপ বা নাগের অলঙ্কার।

মন্দির নির্মাণের কিংবদন্তিতে মন্দির নির্মাণের কাল সুপ্রাচীনকাল বলা হলেও এর নির্মাণকাল তিন-চারশো বছরের বেশি নয়। মন্দিরটি পুরোপুরি দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। মন্দিরের চারদিকে চারটি বিভিন্ন আকারের গোপুরম বা প্রবেশদ্বার রয়েছে। সবচেয়ে বড় গোপুরমের উচ্চতা একশো আট ফুট। সবচেয়ে ছোটটি বাইশ ফুট উঁচু। গোপুরমের গায়ে অসংখ্য সুদৃশ্য ভাস্কর্যে পৌরাণিক কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গোপুরমের মাথায় রয়েছে সোনার কলস। সবচেয়ে বড় গোপুরমের মাথায় কলস রয়েছে নয়টি। গোপুরমের ভেতর দিয়ে প্রবেশের পর মূল মন্দিরে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকটি মণ্ডপ পেরোতে হয়। তারপর নন্দীর বিরাট প্রস্তর মূর্তির পাশ দিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মূল মন্দিরের চারপাশ ঘিরে নানান দেবতা ও গ্রহদের ছোটবড় মন্দির রয়েছে।

মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরে নির্মিত দেবীর মূর্তি রয়েছে। দেবী পদ্মের উপর দণ্ডায়মানা। তাঁর চারটি হাত। দেবীর অঙ্গে রক্তবস্ত্র। মাথায় সাপের মুকুট। কণ্ঠে রত্নমালা ও পুষ্পমালা। দেবী সর্পভূষিতা হয়েও প্রসন্নবদনা, রক্তাম্বরী হয়েও আশ্রয়দাত্রী মা।।

সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত দেবীকে ছ’বার পুজো করার বিধি রয়েছে। ভক্তজন যে-কোন সময় দেবীর পুজো দিতে পারেন। প্রতি শুক্রবার এখানে দেবীকে বিশেষভাবে পূজা করা হয়। নবরাত্রি এবং শিবরাত্রি খুব ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হয়। এছাড়া জুন-জুলাই মাসে সিংহলীদের নববর্ষ উপলক্ষ্যে ষোলদিন ধরে দেবীর মহোৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসবের জাঁকজমক এমন বিচিত্র ও অসাধারণ হয় যে, তা কেবলমাত্র জগন্নাথের রথযাত্রার সঙ্গে তুলনীয়। তাই এই সময় দেবীর মন্দিরে দেশিবিদেশি প্রচুর ভক্তের ভিড় হয়।।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...