Life story of Lord Mahavir: প্রাণ সংশয়েও মৌনব্রতে অটল ছিলেন মহাবীর জৈন

ছোট থেকেই মহাবীর ছিলেন অত্যন্ত শক্তিমান ও সাহসী। ভয় বলে  কোন জিনিস আছে সেটা তিনি জানতেন না। একবার তিনি সমবয়সী ছেলে মেয়েদের সাথে খেলাধুলা করছিলেন হঠাৎ সেখানে এক বিরাট সাপ আসে। সাপ দেখে সবাই তো ভয় পেয়ে যায়, অনেকেই হইচই শুরু করে, ছেলে মেয়েরা সব এক একদিকে ছুটে ছুটে পালায়, মহাবীর কিন্তু অকুতোভয়। সেই সকল ছেলেমেয়েদের মতো একেবারেই ভয় পেল না সে। বরং এগিয়ে  গেল সাপটির দিকে তারপর হঠাৎ খপ করে সাপের লেজটা ধরে ফেলল এবং তারপর সেটাকে কয়েকবার জোরে ঘুরিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল তারপর আবার মন দিল খেলাধুলোয়, যেন কিছুই ঘটেনি। 

খ্রিস্টপূর্ব ৫৯৯ অব্দের চৈত্র মাসের শুক্লো ত্রয়োদশীতে মহাবীরের জন্ম হয় বর্তমান বিহার রাজ্যের উত্তরে বৈশালী নগরীতে। মহাবীর জাতিতে ক্ষত্রিয়। তার পিতার নাম সিদ্ধার্থ ও মাতার নাম ত্রিশলা, ছোটবেলায় তার নাম ছিল বর্ধমান। সাধারণ জ্ঞান বুদ্ধি হ‌ওয়ার পর থেকেই  ধর্মের প্রতি বর্ধমানের মনে অনুরাগ ছিলো ,বয়স বাড়ার সাথে সাথেই উত্তরোত্তর সেই অনুরাগ বাড়তে থাকে। কোথাও সন্ন্যাসীদের দেখা পেলেই  ব্যাকুল হয়ে বর্ধমান তাদের শরণ নেন, উৎকর্ণ হয়ে শোনেন তাদের ধর্ম উপদেশ, মনে মনে ভাবেন কবে কর্মের বন্ধন তার ক্ষয় হবে? কীভাবে হবে পরমপ্রাপ্তি ও নির্বাণ লাভ?

মাত্র ৩০ বছর বয়সেই বর্ধমান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন আর তারপর  ষন্ডবনের এক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তিনি সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন,পরিব্রাজন ও তপস্যার ফলে যে অসামান্য সংযম ও কষ্ট সহিষ্ণুতার পরিচয় তিনি দিয়েছিলেন তার তুলনা কোনো কিছুর সাথেই চলে না। প্রচন্ড শীতের দিনে অন্যান্য সাধকরা যখন আগুন জ্বালিয়ে আত্মরক্ষা করতে ব্যস্ত। তখন তিনি নগ্ন দেহে উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে ধ্যান করতেন, গ্রীষ্মের দুঃসহ তাপের মধ্যেও তিনি নির্বিকার ভাবে বসে ধ্যান করতেন এই সাধনার ফলেই তিনি পরবর্তীকালে মহাবীর নামে অভিষিক্ত হয়ে পরম সাধক ও ধর্মপ্রচারক রূপ খ্যাতি লাভ করে ছিলেন।

যে ২৪ জন তীর্থঙ্কর মহাপুরুষ জৈন ধর্মের প্রবর্তন ও প্রচার করেছিলেন তাদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন ঋষভদেব এ কথা অনেকেই অনুমান করেন। পরবর্তী তীর্থঙ্করদের কথা জানা যায়নি,  ত্রয়োবিংশ তীর্থঙ্কর হলেন পার্শ্বনাথ আর শেষ অর্থাৎ ২৪ তম তীর্থঙ্কর হলেন মহাবীর। মহাবীর এইবার এলেন নালন্দাতে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আওতার বাইরে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলটিতে তখন নতুন নতুন ধর্ম মত ও আদর্শ প্রচারিত হচ্ছে, বিশিষ্ট ধর্ম নেতা ও দার্শনিকের আনাগোনা তখন নালন্দায়। তরুণ সন্ন্যাসী মহাবীরের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, তার শুভ আগমনে নালন্দায় সাড়া পড়ে গেল ও বিশিষ্ট নাগরিকরা এই ত্যাগব্রতী নবীন সাধকের সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়ালেন। 

পরম সাধক গোঁসাল‌ও সেদিন এলেন মহাবীরকে দর্শন করতে, মহাবীরকে দর্শন করে এক দুর্নিবার আকর্ষণে বাধা পড়ে গেলেন তিনি, এরপর গোঁসাল মহাবীরকে গ্রহণ করলেন শিষ্যরূপে।  সাধক হিসেবে গোঁসালের একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, কোন কিছু চাওয়া পাওয়ার ধার করতেন না তিনি, সর্বত্র নগ্ন অবস্থায় থাকতেন তিনি, স্বেচ্ছামতো যত্রতত্র-বিচরণ করতেন- অপরিগ্রহের এই পরিপূর্ণরূপটি মহাবীরকে আকৃষ্ট করতো কিন্তু সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে মহাবীর তাই এক সংস্কারে তার সন্ন্যাসী মন ও উলঙ্গ হতে বাঁধে। অবশেষে মনস্থির করে কোমরে জড়ানো বসনখানি এক ভিখারীকে দান করে ফেলে সন্ন্যাসী মহাবীর হলেন দিগম্বর। 

তারপর মৌনব্রত অবলম্বন করে মহাবীর পরিক্রমায় বের  হলেন। মৌনব্রত কমবেশি সকলেই অবলম্বন করেন, কিন্তু মহাবীরের মৌনব্রত ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম, প্রাণ সংশয় হলেও তিনি কখনো ব্রত ভঙ্গ করেন নি।  মৌনব্রত চলাকালীন  এক অচেনা রাজ্যের মধ্য দিয়ে তিনি পরিক্রমা করছেন, সামলেই পড়ল সেখানকার রাজধানী। রাত্রি হওয়ায় সেখানেই বিশ্রামের উদ্দেশে শুলেন তিনি। কিন্তু ভোর না হতেই নগর রক্ষীরা তাকে ধরে ফেলল আর চোর বলে সন্দেহ করে তারা মহাবীরকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে শুরু করল। কিন্তু মহাবীর নিরুত্তর। কিছুতেই তিনি তার মৌন থাকার সংকল্প ত্যাগ করলেন না। নগর রক্ষীরা তাকে নগর পালের কাছে নিয়ে গেল, নগরপাল আদেশ দিলেন লোকটির গলায় ফাঁসির দড়ি দিলেই পেটের কথা সব বেরিয়ে যাবে। কিন্তু প্রহরীরা পড়ল  বিপদে! তারা যতবার‌ই মহাবীরের গলায় ফাঁস লাগাতে যায়, ততবারই তা খসে যায়, এইরকম সাত বার হল, তখন মহাবীরকে ছেড়ে দেওয়া হল।

মহাবীর কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ইত্যাদিও জয় করেছিলেন বলে তার উপাধি হয় ''জিন''।যারা তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তারা জৈন নামে পরিচিত আর তিনি যে ধর্ম প্রচার করেন সেই ধর্মই হয়ে ওঠে জৈন ধর্ম।

পার্শ্ব নাথ বলেছিলেন, ৪ সংযমের কথা, অহিংসা , সত্য, অচৌর্য ও অপরিগ্রহ। মহাবীর এর সঙ্গে পঞ্চম সংযম যোগ করলেন, তা হল ব্রহ্মচর্য। মহাবীরের অনুগামীদের বলা হয় নির্গ্রন্থ অর্থাৎ বন্ধন মুক্ত। জৈন ধর্ম অনুসারে মানুষ তার নিজস্ব কর্মফলের হাত থেকে নিস্তার পেলেই মুক্তি লাভ করে আর জৈনরা জীবের অহিংসা আত্মপীড়ন ও কৃচ্ছসাধনই  ধর্ম লাভের প্রধান সোপান বলে জ্ঞান করেন। 

শুধু সংসার ত্যাগী সাধননিষ্ঠ নির্গ্রন্থ সন্ন্যাসীদেরকেই নয়, সংসারধর্মী ভক্তদেরও মহাবীর শুনিয়েছিলেন আশ্বাস বাণী। গৃহীভক্তদের তিনি বলেছেন ,"নিষ্ঠাভরে আমার উপদেশ মেনে চলো, তাহলে গৃহী হয়েও তোমরা পাবে অলৌকিক দৃষ্টি ও সাধনা ঐশ্বর্য। ক্ষয় হবে তোমাদের সকল কর্মবন্ধন।" পরবর্তীকালে মহাবীরের প্রধান শিষ্য ইন্দ্রভূতি গৌতম তাকে প্রশ্ন করেন,"  প্রভু আপনি একি করছেন?

সন্ন্যাসী আর গৃহস্থ্য ভক্তের মধ্যে কোন প্রভেদ‌ই যে আপনি রাখতে চান না? এ কিন্তু আপনার মহা অবিচার। সমস্ত ভোগ সুখ ছেড়ে  কৃষ্ণ সাধনের মাধ্যমে যেসব সন্ন্যাসীরা দুশ্চর তপস্যাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন,তাদের জন্য বিশেষ সাধন পন্থা থাকবে না কেন? সন্ন্যাসী আর গৃহীর আসন হবে সমপর্যায়ে ভুক্ত? এ কেমন কথা? "

অবিচল কণ্ঠে মহাবীর উত্তর দেন," না , ইন্দ্রভূতি , আমার প্রচারিত সার্বজনীন ধর্মে বৈষম্যের কোন স্থান নেই। এই ধর্মের দৃষ্টিতে সন্ন্যাসী ও গৃহীর মান মর্যাদা ও অধিকার সমান সমান থাকবে।"জৈন ধর্মমতে ভগবানের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, বেদকে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী বলেও মনে করে না। জাতিভেদ ও জৈনরা মানে না। জৈন ধর্ম মতে নির্বাণ অর্থাৎ পুনর্জন্ম থেকে আত্মার সম্পূর্ণ মুক্তি লাভের তিনটি পথ আছে-সৎ জ্ঞান,সৎ কর্ম ও সৎ ব্যবহার।

মহাবীর বলতেন-জীব হিংসা করো না, মিথ্যা কথা বলো না,চুরি করো না,পবিত্র জীবন যাপন করো- এই উপদেশগুলো ছিল জৈন ধর্মের মূলনীতি. মহাবীরের উপদেশ গুলি পরে বারোটি ভাগে সংকলিত হয়েছিলো। অঙ্গ নামে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে জৈন রা দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে যান একটি হলো দিগম্বর, অপরটি শ্বেতাম্বর।  জৈন ধর্ম পূর্ব ভারত থেকে ধীরে ধীরে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, আজও গুজরাট ও রাজস্থানের স্থানে বহু জৈন রা বাস করে। উল্লেখ্য,৭২ বছর বয়সে মহাবীর পাটনার নিকট পাবা নামক স্থানে দেহত্যাগ করেন,রয়ে যায় তার প্রচারিত ধর্ম মত, যে মতে ও পথে বিশ্বাস রেখে নির্বাণ লাভের পথে হেঁটে চলেছেন অসংখ্য জৈনরা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...