রাজনটী লক্ষহীরাকে হরিভক্তে রূপান্তর করে ছিলেন ভক্ত হরিদাস

২৪ পরগনা জেলার দত্ত পুকুর স্টেশনের কাছে বূঢ়ণ গ্রামে নামকরা পন্ডিত মনোহর চক্রবর্তীর পুত্র সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করলেন হরিদাস।   এই হরিদাস‌ই পরবর্তীতে মহাভাগবত প্রধান ভক্তরাজ হরিদাস হয়ে ওঠেন। ‌মনোহর চক্রবর্তীর অনেক বেশি বয়সে এই সন্তান জন্ম হয়। এই সন্তান জন্মের জন্য অনেক পুজো মানত করেছিলেন তিনি। অবশেষে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ শ্রী গৌরাঙ্গের জন্মের ঠিক ৩৫ বছর আগে মনোহর চক্রবর্তীর ছেলে হরিদাসের জন্ম হয়। তবে এই ছেলের জন্ম হয়েছিল গন্ডযোগে, যে যোগে জন্মগ্রহণ হলে পিতা ও মাতার অকাল প্রয়াণ হয়, জ্যোতিষীর বিচার সত্যি করে বাস্তবেও তাই ঘটল। দুই বছর পরে মনোহর চক্রবর্তী তিন দিনের জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। তার স্ত্রী ও স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় নিজের জীবন বিসর্জন দিলেন। তার আগে তিনি হাবিবুল্লাহ কাজীর স্ত্রীর হাতে নিজের একমাত্র শিশু পুত্র হরিদাসকে দিয়ে যান।

হাবিবুল্লাহ কাজীর স্ত্রীর সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল মিশ্র মহাশয়ের স্ত্রীর। সেই কারণে হাবিবুল্লার ঘরেই বড় হতে থাকল হরিদাস। ১০ বছর বয়সেই সে উর্দু, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় অসামান্য পারদর্শিতা অর্জন করল। এইসময় কাজী দম্পতি আশা প্রকাশ করলেন যে,তিনি ছেলেকে যথাসময়ে বিবাহ দিয়ে ঘরে বউ আনবেন কিন্তু যে ছেলে ভক্ত শিরোমণি হবেন তাকে ঘর আর কী প্রকারে টেনে রাখবে? তাই কাজী সাহেব এবং তার স্ত্রীর সেই আশা সফল হলো না ,মাত্র বছর বয়সেই যখন হরিদাস  ঘর ছেড়ে চলে গেল। 

হাঙ্গর নদীর ধারে বেনাপোলের জঙ্গলে হরিদাস আশ্রম তৈরি করে এরপর হরি নাম জপ করতে থাকলো। চন্দনের সুগন্ধ যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তেমনি গভীর বনে সাধনা করলেও হরিদাসের হরি ভক্তির কথা ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, একজন, দুজন দুজন করে ভক্ত আসতে শুরু করলো তার বনের কুঠিরে। সেই সময় সেই অঞ্চলে শ্রীরামচন্দ্র খাঁ বলে এক জমিদার ছিলেন, বাংলার নবাব হুসেন শাহের দয়ায় তিনি বেশ প্রভাব ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন। হরিদাসের কথা তার কানে এসে পৌঁছায়, হরিদাস যে ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মেছিলেন সেটা তিনি জানতে পারলেন না, তিনি শুধু শুনলেন হরিদাস জাতিতে মুসলমান, সে বৈষ্ণব হয়ে হিন্দুর মতো হরিনাম জপ করছে আর হিন্দু মহিলারা তাকে দেখার জন্য ভিড় করে আসছে। তিনি হরিদাসকে ভন্ড ভাবলেন এবং হরিদাসকে পরীক্ষা করবেন বলে ঠিক করলেন।

রামচন্দ্র খাঁ বললেন, এইসব ভন্ডামি আমার জমিদারিতে চলবে না তিনি লক্ষহীরা নামের এক সুন্দরী বারবনিতাকে পাঠালেন হরিদাসকে যাচাই করবার জন্য, কিন্তু কি আশ্চর্য কোথায় লক্ষহীরা হরিদাসকে বশীভূত করবে, তা নয় নিজেই বশীভূত হয়ে সন্ন্যাস ধর্ম নিয়ে নিল সে। অসৎ উপায়ে সঞ্চিত বিপরীত অর্থরাশি হীরার জীবনে ভার স্বরূপ মনে হল, সেই অর্থ দিয়ে বেনাপোল থেকে পুরী পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তায় পথ নির্মিত হলো, যা হীরার জাঙ্গাল নামে খ্যাত। গুরু হরিদাসের জন্মস্থানে ও হীরা প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করিয়ে দেয় তার নাম নটীর জাঙ্গাল হয়, নিজের সমস্ত সম্পত্তি লোকের হিতে  উৎসর্গ করে হীরা পুরী ধামে গিয়ে বাস করতে থাকে।

বাংলায় তখন মুসলমানের রাজত্ব চলছে, মুলুকপতি কাজীর কাছে নালিশ গেল 'হাবিবুল্লা কাজীর বেটা ব্রহ্ম হরিদাস' ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু হয়েছেন। 

তার মন্ত্রী গোরাই কাজী ছিলেন একজন গোঁড়া মুসলমান , হরিদাসের এ হেনো আচরণ শুনে তিনি আদেশ দিলেন হরিদাসকে ধরে আনার জন্য। হরিদাস এলে তিনি তাকে হুকুম করলেন, তোমাকে কলমা পড়ে মুসলমানের মতই থাকতে হবে আর হরিনাম ছাড়তে হবে কিন্তু হরিদাস তাদের কথায় রাজি হলেন না , জানালেন হরিনাম ছাড়া তার পক্ষে অসম্ভব। তখন গোরাই কাজী হুকুম দিলেন ," ওকে বাইশ বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেত মারো।"

জল্লাদরা কাজীর হুকুম তামিল করল, ১ মাইল জুড়ে বাজার,তার ২২ টি দেউড়ি, তাই তার নাম বাইশ বাজার‌। সেই বাজারে হরিদাসকে ঘোরাতে লাগলো আর বেত মারতে লাগলো, হরিদাস তবুও হরিনাম বন্ধ করলেন না। চাবুকের কঠিন আঘাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন , কাজীর দরবারে খবর গেল হাকিম এসে পরীক্ষা করে দেখলো, সে মৃত। তখন তারা মৃত হরিদাসের দেহ জলে ভাসিয়ে দিল। কিন্তু হরিদাস মরেনি, ওই যে কথায় আছে না, রাখে কৃষ্ণ, মারে কে?হরিদাসের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হল। কুম্ভক অবস্থায় ভাসতে ভাসতে তিনি ফুলিয়া তীরে এসে পৌছলেন। ফুলিয়ার সাধন মাঠে শুরু হল তার সাধনা। হরিদাস শান্তিপুরে গেলেন, অদ্বৈতাচার্যের সঙ্গে দেখা হল তার দেখা হল শ্রী গৌরাঙ্গের সঙ্গে, হরিদাস শ্রীগৌরাঙ্গকে সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ রূপে পূজা করলেন এইভাবেই ভক্ত ও ভগবানের মিলন হল। 

এরপর শ্রী গৌরাঙ্গ, হরিদাস ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভু ভক্তদের নিয়ে নদীয়ার পথে পথে দিগ্বিজয়ে বেরোলেন,পথে জগাই,মাধাই উদ্ধার হলো,উদ্ধার হলো মুসলমান চাঁদ কাজী। মহাপ্রভুর কথা শুনে হরিদাস নীলাচলে গেলেন  কিন্তু মন্দিরে ঢুকলেন না। অদূরে বকুলতলায় বসে হরিনাম জপ করতে থাকলেন, সেখানেই তার সাধন কুটির গড়ে উঠলো। প্রভুর দর্শন করতে এসে নীলাচলে এসে শ্রী রূপ গোস্বামী প্রথমে ঠাকুর হরিদাসের সাধন কুটিরে এসে উপস্থিত হন। শ্রী চৈতন্য প্রত্যেকদিনই জগন্নাথ দর্শন সেরে ভক্ত হরিদাসের উদ্যানকুটিরে এসে তার সঙ্গে মিলিত হতেন, সেখানেই শ্রীরূপের সাথে প্রভুর সাক্ষাৎ করিয়ে দেন হরিদাস। ভক্ত প্রবর সনাতন গোস্বামী পুরীধামে এসে হরিদাস ঠাকুরের পদবন্ধনা করে তার কুটিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

হরিদাস যখন বৃদ্ধ হন অসুস্থ হয়ে পড়েন তখনও তিনি প্রতিদিন ৩ লক্ষ বার নাম জপ না করে কিছু আহার করতেন না। একদিন মহাপ্রভুকে তিনি বলে ছিলেন "আমি তোমার শ্রীপাদপদ্ম আমার হৃদয়ে রেখে এবার যেতে চা‌ই, তোমার নাম উচ্চারণ করতে করতেই আমি চোখ বুজতে চাই , প্রভু।" সত্যি একদিন মহাপ্রভুর পদযুগল পক্ষে ধারণ করে নাম সংকীর্তন শুনতে শুনতে ভক্ত হরিদাস ইহলীলা সংবরণ করেন। তার তিরোধান উৎসবের জন্য শ্রীচৈতন্য নীলাচলের জনগণের কুটিরে কুটিরে নিজে গিয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করেছিলেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...