আকাল-মানুষ আর তার উৎসব- হৃদয়

গৌরী-আলো গড়িয়ে পড়ে ভোর-শিউলির গায়ে। সে আলতো পরশ লেগে শিশিরের জল ঘাসের চিবুক থেকে মিলিয়ে আসে ক্রমে। তার আগে অল্প কিছুক্ষণের জন্য স্ফটিকের বর্ণ খুঁজে পায়। শুভ্র কাশের বুকে দোল খায় শরৎ-বাতাস, পেঁজা তুলো মেঘদল ফিরোজা আকাশে আঁকে খড়ি-আলপনা। বছর ঘুরে উমা আসছেন বাপের বাড়ি।

আনন্দ নাড়ুর তোড়জোড় শুরু হয় মা মেনকার হেঁসেলে। পিতা গিরিরাজ হাঁকডাক করে প্রস্তুত রাখেন কাহার, দোলা, অশ্ব, গজ, নৌকা। যেমনই থাকুক পরিবেশ, ঠিক বাঁচিয়ে যত্নে ঘরে আনবেন অপর্ণা। নিকনো উঠোনে, বিল্ববৃক্ষমূলে ঘিয়ের প্রদীপ ঘিরে বোধনের ঘট পাতা হবে।

rivu-1

 

অপেক্ষায় স্থির হয়ে আছে গাছ। গাছের কোটরে বসা নীলকন্ঠ পাখির ডানায় আগেই এসেছে সন্দেশ, উমা আসবার। সেদিন থেকে বোষ্টমের ভাঙা গলায় খেলে বেড়াচ্ছে আগমনী সুরের লহরী। কোঁচড় উপচে যাওয়া মাধুকরী জোটে না তবুও এ কদিন তার গলাতেও হাসিখুশি গান। আনন্দমাধুরী।

‘বহুদিন পরে আসিবে ঘরে উমা আমার।

উমা বিহনে না হেরি নয়নে, ত্রিলোক হয়েছে আঁধার।

শরত-আকাশে মেঘ ভাসে, উমারে হেরিতে ধায় উল্লাসে,

নদী কুলুকুলু রবে নেচে নেচে চলে চরণ ধোয়াবে তার ।।’

সেই রাঙা চরণের ওপর আলতার শেষ পোঁচটুকু পরিয়ে দেন পোটো। চোখ আঁকা হয়ে গেলে খানিকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখেন। দৃষ্টি গাঢ় হয়ে আসে দেবী ও শিল্পী দুজনার, একই সঙ্গে প্রায়। মহিষাসুরের বুক থেকে গড়িয়ে পড়া টাটকা রক্তে জিভ বুলিয়ে নেয় সিংহ। সেই নৃশংসতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভয়ে আরো সাদা হয়ে যান সরস্বতী। কার্তিকের নবীন গোঁফের প্রেমে পড়ে যান কার্তিক নিজেই। আর লক্ষ্মী পান চিবোনো ঠোঁটে মুচকি হাসেন এসব দেখে। আহ্লাদে গদগদ গণেশ, লাল টুকটুকে হয়ে ওঠেন আরো, মামার বাড়ির আদর যত্নের ঠেলায়।

ঠাকুর দালানের পায়রাগুলো খুশিয়াল গলায় গল্প জুড়ে দেয় গড়ে ওঠা প্রতিমার সাথে। পূজারির রেখে যাওয়া এক আঁজলা শিউলি গরমে ভেপসে উঠে নেশালাগা গন্ধ ছড়ায়। সবাই একসঙ্গে দিন গুনছে। উৎসবের বেশিদিন বাকি নেই আর।

যদিও অন্যবারের থেকে পুজো অনেকটা আলাদা এবার। রোগ, ভয়, মৃত্যু, মারি সমস্ত নিয়ে জেরবার হয়ে রয়েছে সবাই। তবু এই আকালের মধ্যেও মানুষ চেয়ে আছে উৎসবের দিকে। হয়তো চিরকালই এমন ভাবে তারা অভাব ছাপিয়ে আনন্দের দিকে তাকায়। মধুময় করতে চায় পরমায়ু, তা সে যত স্বল্প সময়ের জন্যই হোক না কেন। সবার ইচ্ছে তাকে যেন আনন্দময় করে তোলা যায়। মহাভারতের সেই লোকটার কথা মনে পড়ে কেবল। কূপের মধ্যে ভঙ্গুর বৃক্ষশাখে ঝুলে রয়েছে যে। উপরে মত্ত হাতি, নীচে বিষধর সাপ। ভঙ্গুর শাখায় প্রকান্ড মৌচাক, তা থেকে গড়িয়ে পড়ছে মধু। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখেও সেই মানুষটা চেষ্টা করছে গড়িয়ে পড়া মধু পান করার। আশ্চর্য এই জীবন! মিলিয়ে যাবার আগে সবাই একবার স্ফটিকবর্ণ ধারণ করতে চায়। মেঘের শরীর নষ্ট হবার পূর্বে রেখে যেতে আলপনার অন্তত একটা নির্ভুল আঁক।

rivu

হাজার মড়ক পেরিয়ে এসেও উৎসব মরে না তাই। জীবনের সেই সনাতন ইচ্ছের ওপর দোল খাচ্ছে আশ্বিনের আলো। খেলে যাচ্ছে ভয় ভাবনার ছায়া। বাঁধন হারা মাতোয়ারায় যদি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী তখন কাকে দোষ দেব আমরা? আশ্রয়ই বা পাবো তখন কোথায়?

উত্তর খুঁজতে বিগতের দিকে তাকাই। বাহুল্য পছন্দ করে না প্রকৃতি। ছন্দপতন তার নেই কোথাও। এই শারদীয়াও বুঝি সংযমের বার্তা দিচ্ছে আবার। শেখাতে চাইছে সেই ভুলে যাওয়া মন্ত্র। উৎসব যেন অন্তরের হয়। তাকে ঝুঠো আলোয় মুড়ে যেন বীভৎস উল্লাসমঞ্চ বানিয়ে না তুলি আমরা। পরিমিতি জ্ঞানের দিকে মন দেওয়া দরকার।

উমা আসার পথটুকু যেন সুগম হয়। শুধু এই বার নয়। বার বার। দুর্গতিনাশিনীর কাছে কেবল এটুকুই আশীর্বাদ চাওয়ার।

'দেবী প্রপ্পনার্তি হরে প্রসীদ।।'

 

ছবিঃ লেখক

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...