"রানী গাইডিলিওর দু’চোখে দুখন্ড নীলা জ্বলছে। কিন্তু কন্ঠ কী শান্ত, কী গম্ভীর। ' আমি অনেক ভেবে দেখেছি আমাদের এই পাহাড় থেকে সাহেবদের হটিয়ে দিতে হবে। ওরা এসে জোর করে খ্রীষ্টান করছে, আমাদের ধর্ম নষ্ট করছে। সমতলের বাসিন্দাদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচ্ছে। পাহাড়ে এসব চলবে না"- এমনটি ভেবেছিলেন পরাধীন ভারতের অবহেলিত উত্তর পূর্ব ভারতের মণিপুরের এক নাগা কিশোরী কন্যা গাইডিলিও পামেই। অনেক পরে নিজের অনমনীয় বিপ্লবী জীবনযাপনের জন্য যিনি খ্যাত হয়েছিলেন রানী গাইডিলিও নামে।
কে ছিলেন এই রানী?
ভারত-ইতিহাসের পাতায় রানী অহল্যাবাঈ, রানী লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা, রানী গাইডিলিওর অবদান ক’জনের জানা আছে? অথচ ভারতের পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার আলো জ্বালাবার দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন। তাঁর আহ্বানে পাহাড়ের পাথরে পাথরে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন।
১৯১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের মণিপুরের নুংগকাও অথবা লঙখাও গ্রামে গাইডিলিও পামেই-এ জন্ম। বাবা লোথানাঙ্ ও মা কাছাকলেনলিউ ছিলেন নাগা উপজাতি ভূক্ত। বর্তমানে এই গ্রামটি মণিপুরের তামেনলঙ্ জেলার অন্তর্গত। গাইডিলিও ছিলেন আট ভাইবোনের অন্যতম। তখনকার মণিপুরে লেখাপড়া শেখার কোনও ব্যবস্থা না থাকায় গাইডিলিও স্কুলে পড়ার কোনও সুযোগ পাননি।
বিদ্যালয় শিক্ষার সুযোগ না পেলেও গাইডিলিও ছিলেন আত্মসচেতনতার আলোয় দীপ্ত। ১৯২৭ সালে যখন তিনি মাত্র তেরো বছরের কিশোরী তখন তিনি হেরাকা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। হাইপো জাডোনাঙ্-এর এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল জনজাতিদের নিজস্ব ধর্মের পুনরুত্থান এবং স্বাধীন নাগারাজ্য। মূলত ধর্মীয় এই আন্দোলন প্রভাবিত করেছিল কয়েকটি নাগা গোষ্ঠীকে। মণিপুরি ব্যবসায়ীদের হত্যার অভিযোগে ১৯৩১ সালে জাডোনাঙ্-এর ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা। ধর্মীয় আন্দোলন থেকে হেরাকা আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। জাডোনাঙ্-এর মৃত্যুর পর গাইডিলিও এই আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় বলেছিলেন," আমরা( অর্থাৎ জনজাতিরা) মুক্ত মানুষ। শ্বেতাঙ্গদের শাসন আমরা মানব না"।
জাডোনাঙ্-এর মৃত্যুর পর গাইডিলিও তাঁর ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক উত্তরসূরী হয়ে ওঠেন। জনজাতি সত্তার স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনচেতা মানসিকতায় দীপ্ত এই নারী খোলাখুলি ব্রিটিশ রাজত্বের বিরোধিতা করতেন। ব্রিটিশদের কর দিতে তীব্র আপত্তি জানাতেন। নাগা জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে নানা বিষয়ে মতভেদ ও বৈরিতা থাকলেও গাইডিলিও সবার কাছেই শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছিলেন। মিশনারীদের ধর্ম পরিবর্তনের পদ্ধতিকে গাইডিলিও তীব্র ধিক্কার জানিয়ে নাগা জনজাতিদের নিজস্ব বিশ্বাসে অনড় থাকতে বলেছিলেন। তাঁর তীব্র ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে শাসক গোষ্ঠী তাঁকে গ্রেফতারের আদেশ দিলেও গাইডিলিও আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুরের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ব্রিটিশ শাসকদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে অনায়াসে পালিয়ে বেড়াতেন। ওই অঞ্চলগুলিতে তাঁর প্রভাব এত গভীর ছিল যে ব্রিটিশ পুলিশও তাঁকে ছুঁতে পারেনি। ১৯৩২’র ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে গাইডিলিওর অনুগামীরা অসম রাইফেলসের সৈন্যদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে।ওই বছরের ১৭- ই অক্টোবর কেনোমা গ্রামের কাছে এক আকস্মিক সংঘাতে গাইডিলিওকে গ্রেফতার করে অসম রাইফেলসের সৈন্যরা। এই গ্রেফতার তাঁর অনুগামীরা সহজে মেনে নেয়নি। ১৯৩২র ডিসেম্বর মাসে লাকেমা ইন্সপেকশন বাংলোর চৌকিদারকে পুলিশের চর সন্দেহে তারা হত্যা করে। গাইডিলিও তাঁর ওপর আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়।
১৯৩৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গাইডিলিও গুয়াহাটি, শিলং, আইজল এবং তুরা জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন।১৯৩৭ সালে জওহরলাল নেহরু যখন তাঁর সঙ্গে শিলং জেলে দেখা করেন তখন তিনি গাইডিলিওকে তাঁর মুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। নেহরুর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে রাজি হয়নি। নেহরুই তাঁকে 'পর্বতকন্যা' ( Daughter of the hills) এবং 'রানী' আখ্যা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ কারাবাসকালে নেপালি, বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। জেলে সহবন্দি একজনের শিশুপুত্রের সঙ্গে তাঁর গভীর মমতাময় সম্পর্কের কথাও জানা যায়।১৯৪৬ সালে (মতান্তরে ১৯৪৭)সালে তুরা জেল থেকে গাইডিলিও মুক্তি পান। জীবনের অমূল্য চৌদ্দ বছর তাঁর দিন কেটেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের এক জেলে থেকে অন্য জেলে। স্বাধীনতার দাবিতে অনমনীয় থেকে।
স্বাধীনতার পতাকাতলে অবশেষে মুক্ত জীবন পেয়েছিলেন গাইডিলিও। জীবনের এই পর্যায়ে তিনি তাঁর জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনের উন্নতিতেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আকাশ থেকে খসে পড়া উল্কা তখন প্রদীপশিখা। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ইম্ফলে গেলে গাইডিলিও তাঁর সঙ্গে দেখা করে নিজের মুক্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জানান এবং তাঁর জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্য ভারত সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।
ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য দীর্ঘ সময় কারান্তরালে থাকলেও গাইডিলিও সব নাগা জনজাতির কাছে সমানভাবে সমাদৃত হননি। তিনি ভারতরাষ্ট্রের মধ্যেই স্বতন্ত্র জেলিয়াঙগ্রঙ্ অঞ্চলের দাবি জানিয়েছিলেন। বিদ্রোহী নাগা নেতারা এই দাবিকে সমর্থন করেননি। ধর্মান্তরিত নাগারা গাইডিলিও-র প্রাচীন নাগাধর্ম তথা হেরাকা-য় আস্থাকেও মেনে নিতে পারেনি।অগ্নিকন্যার শিখা তখনও নিভে আসেনি।তাই হেরাকা সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য এবং নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য তিনি ১৯৬০ সালে অন্তরালে চলে যান।১৯৬৬ সালে যথেষ্ট পরিণত বয়সে অন্তরালের জীবন থেকে সর্বসমক্ষে এসেছিলেন রানী গাইডিলিও। ভারত সরকারের সঙ্গে তিনি চুক্তিবদ্ধ হন যে নিজের জনজাতির জন্য তাঁর আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং অহিংস। ১৯৬৬-র জানুয়ারি মাসে তিনি কোহিমা গেলে তাঁকে দেখার জন্য পথে ভীড় জমে যায়। রানী সত্যিই কোহিমায় এসেছেন সেকথা লোকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও পৃথক জেলিয়াঙগ্রঙ্ অঞ্চলের দাবি তোলেন। কিন্তু এই দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৬৬-র সেপ্টেম্বর মাসে হেনিমায় গাইডিলিও-র ৩২০ জন অনুগামী আত্মসমর্পণ করে। শেষ হয় ভারত ইতিহাসের এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। যে অধ্যায়ের কেন্দ্রে ছিলেন রানী গাইডিলিও-এক ব্যতিক্রমী বিপ্লবী যিনি নিজের কৌম সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য চিরদিন সচেষ্ট ছিলেন।
গাইডিলিও-র আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি, তবে তাঁর লড়াই স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর তাম্রপত্র, পদ্মভূষণ, বিবেকানন্দ সেবা পুরস্কার ইত্যাদি নানা সম্মান তিনি পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে গাইডিলিও ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি লোঙকাওতে। সেখানে, সেই তাঁর দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পর্বতকন্যা রানী গাইডিলিও। দিনটি ছিল ১৯৯৩-র ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেই বছরে তাঁর স্মরণে গড়ে তোলা হয় "রানী গাইডিলিও ফাউন্ডেশন"। মণিপুরে ‘রানী গাইডিলিও ট্রাইবাল ফ্রিডম ফাইটার্স মিউজিয়াম’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। তাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১০০ টাকা মূল্যের বিশেষ মুদ্রা এবং ৫ টাকার মুদ্রায় ধরে রাখা হয়েছে তাঁর প্রতিকৃতি। এভাবেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এক বিদ্রোহিনী জনজাতিকন্যার সংগ্রামকে। তাঁর শিকড়ের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার আকাঙ্ক্ষাকে, তাঁর দেশের মাটি ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার প্রয়াসকে। স্বাধীনতার ৭৫তম বছরে পর্বতকন্যা রানী গাইডিলিওর জন্য তাঁর দেশবাসীর পক্ষ থেকে রইল গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণতি।"ওই আলোতে নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে/সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে"।