‘আমার বাপের বংশে, মায়ের বংশে কেউ কখনও অভিনয়-টভিনয় করত বলে জানি না...গানটান গাইত তাও দেখিনি আমি ছেলেবেলায়।‘ –শম্ভু মিত্র
১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট দক্ষিণ কলকাতার ডোভার রোডে মাতামহ ডাঃ আদিনাথ বসুর বাড়িতে জন্ম। বাবা শরৎ কুমার মিত্র। মা শতদলবাসিনি দেবী। আট সন্তানের মধ্যে শম্ভু মিত্র সপ্তম গর্ভের দ্বিতীয় সন্তান। ছোটবেলায় নাম ‘ শম্ভুনাথ’। পরে শুধুই ‘ শম্ভু’।
পড়াশোনা বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে। কলেজ সেন্ট জেভিয়ার্স।
বালিগঞ্জ স্কুলেই ঘটেছিল ঘটনাটি। সেখানে আর পাঁচটা স্কুল ছাত্রের মতই নাটক, আবৃত্তি, ইংরেজি কবিতা বলতেন। কিন্তু গোল বেঁধেছিল নাটক করতে গিয়ে। ক্লাসের বন্ধুরা মিলে ঠিক করল একটি নাটক করবেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শাহজাহান। মহলা চলছে জোর কদমে। কিন্তু হেড মাস্টার মশাই এসে দিলেন বন্ধ করে সব কিছু।
থিয়েটারের নেশা সেই যে তাঁর জীবনের পাশে এসে জায়গা করে নিল, সে নেশাই হল আজীবনের সঙ্গী। নেশা বললে ব্যাপ্তি কম হয়ে যায়। কিন্তু নেশা ছাড়া আর কী বা বলা যায়। তার জন্য ঘর ছাড়া। সুদূর এলাহাবাদ থেকে কলকাতা পাড়ি। জীবনের গতি কোন দিকে নিয়ে যাবে কিছু জানা নেই কিন্তু ওই যে বুকের মধ্যে নেশার খলবলানি।
এলাহাবাদের সন্ধে। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে কানে এল নাটকের সংলাপ। কার বাড়িতে রেকর্ড বাজছে। আলমগীরের সংলাপ বলে চলেছেন শিশির ভাদুড়ি। নিশি ডাকের মতো কলকাতায় এসে পড়েছিলেন বছর ২১-এর শম্ভুনাথ মিত্র ওরফে শম্ভু মিত্র। তারপর থেকে জীবনের সঙ্গে চামড়ার মতো জুড়ে গেল কলকাতা।
মঞ্চে অভিনয় দেখার ঘেরাটোপ তাই নিষেধ মানেনি। বাবাকে লুকিয়ে নাটক দেখা চলতই। প্রথম মঞ্চ দর্শন। চোখের সামনে শিশির ভাদুড়ি। তখন তাঁর বয়স ১৫ কী ১৬। শিশিরই হয়ে ওঠেন তাঁর নাট্য গুরু। তবে দু'জনের ফর্ম ছিল পৃথক।
তিনি প্রথম নাটক কে কাব্যের মর্যাদা দিয়েছিলেন। বলা হয় বাংলা নাটক কে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছিলেন শম্ভু মিত্র। বাচিক শিল্প কেও। তাঁকে অনেকে বাচিক শিল্পী বলে, আদতে তিনি বাচিক অভিনেতা। বাদল সরকারের ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ তাঁর কন্ঠে অন্য মাত্রা পায়। ট্রানজিস্টর-এর যুগে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল ইন্দ্রজিৎ। ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তকরবী, ছেঁড়া তার, মুক্তধারা, চার অধ্যায়, বিসর্জন, তাহার নামটি রঞ্জনা -এরকম অনেক বেতার প্রযোজনাও।
১৯৫০ সাল থেকে ‘বহুরূপী’ নাট্যদল চেনা ছক ভেঙে নতুন রকম নাট্য প্রযোজনা শুরু করে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রাণ পুরুষ। তাঁর মেধা, মন, মনন উজাড় করে দিতেন। মঞ্চ সজ্জা থেকে শুরু করে প্রযোজনা, অভিনয় সবেতেই প্যাটার্ন ভেঙে দেওয়া। পারফেকশন এর দিকে তীক্ষ্ণ নজর। ছেঁড়া তার, চার অধ্যায়, রক্ত করবী, পুতুল খেলা, রাজা অয়দিপাউস বাংলা তো বটেই ভারতীয় নাট্য ইতিহাসে দলিল হয়ে আছে। বিশেষ করে রবীন্দ্র নাটকের ক্ষেত্রে। তিনি বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাটক শুধু নাটক নয়, কাব্য।...তাতে সমাজ যেমন স্পষ্ট। ব্যক্তিও তেমনি স্পষ্ট।
শুধুমাত্র নাট্যমঞ্চের পরিসর নয়, সিনেমার পর্দাতেও তাঁকে দেখা গিয়েছিল। ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানি গড়েছিলেন। শুভবিবাহ, মানিক, সূর্যস্নান তিনটি ছবি মুক্তি পায়। জনপ্রিয়ও হয়েছিল।
তাঁর সময়ের অস্থিরতা, ডামাডোল, মানুষের বিপন্নতা, দেশ ভাগ, দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, পরাধীন জাতির আত্মাভিমান কে সরাসরি মঞ্চে তুলে ধরেছেন। মানুষের কাছে যা থিয়েটারের আসল দায়, একমাত্র দায়িত্ব। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া। মানুষের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, অপমান, মর্মবেদনার বাণী। তাই তার সৃষ্টির ভাষা।
তিনিই আঁধার ঘরের রাজা। তিনিই চাঁদবেনে। তিনিই কর্ণ। তিনিই শম্ভু মিত্র। আসলে 'অন্বেষণ'। যিনি সবাইকে বলেন, কাঁধের ঝোলায় সব সময় একটা বই রেখো।
আজ তাঁর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী।
পরিশেষে রইল তাঁরই অনূদিত অনন্য আর এক নাট্যসম্রাট ব্রেখট-এর পঙতি-
“তোমরা যারা এই বন্যার মধ্য থেকে জেগে উঠে দাঁড়াবে
যে বন্যাতে আমরা সবাই তলিয়ে গেলাম-
সেই তোমরা যখন আমাদের ত্রুটিগুলোর কথা বলবে
তখন এতটুকুও ভেবো
যে কোন এক অন্ধকার যুগে আমরা বেঁচেছি
যে অন্ধকার থেকে তোমরা বেঁচে গ্যাছো।“
তথ্য ঋণঃ (রঙ্গ পট নাট্যপত্র ২০১৫)