সন্ধ্যা পাড়ি দিলেন ওপারে

বাংলা সঙ্গীত জগৎ হারাল কিংবদন্তিকে, তিমির সন্ধ্যায় অস্ত গেলেন সন্ধ্যা। চলে গেলেন বাংলা গানের স্বর্ণযুগ শিল্পীদের শেষ তারকাও!
 
মাত্র ১২ বছর বয়সে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা, ১৪ বছর বয়সেও প্রথম হয়েছিলেন। গীতশ্রীর জীবনের সূচনা লগ্নই বলে দিচ্ছিল তিনি কে। খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, পুরাতনী, আধুনিক, বেসিক বাংলা সঙ্গীতের প্রতিটি ধারায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। তখন ১৯৫০–৫১ সাল, দাদার সঙ্গে গিয়েছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে।
 
সেখানে উপস্থিত ছিলেন বড়ে গুলাম আলি। শোনা যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হাতে লাল সুতোর নাড়া বেঁধে, তাঁকে গুড় ছোলা খেতে দিয়েছিলেন। প্রথমে বড়ে গুলাম আলি খান, তারপর তাঁর পুত্র ওস্তাদ মুন্নাওয়ার আলি খান-এর কাছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন সন্ধ্যা। বড়ে গুলাম আলি খান-কে তিনি 'বাবা' বলেই সম্বোধন করতেন। মুনাওয়ারকে সন্ধ্যা ডাকতেন 'ভাইয়া' বলে, মুনওয়ার ডাকতেন '‌সন্ধ্যাদি'‌। তাঁর তত্ত্বাবধানেই বড়ে গোলাম আলির হিন্দি ঠুংরি বাংলায় রেকর্ড করেন সন্ধ্যা।
 
 
sandhyamukherjee1
 
 
শুধু বড়ে গুলাম আলি নয়, আরেক সঙ্গীত কিংবদবন্তি বেগম আখতারের সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন সন্ধ্যা। বেগম আখতার নিজে হাতে তানপুরা বাঁধতে শিখিয়েছিলেন সন্ধ্যাকে। তাঁকে অনেক অনুষ্ঠানে তানপুরায় সঙ্গতও করেছিলেন সন্ধ্যা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নিলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বেশিরভাগই স্মরণীয় গানই আধুনিক বাংলা গান। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের লং প্লে রেকর্ড করার স্বপ্ন ছিল তাঁর, যা পূরণ হয়নি। পুজোর গানকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল। আর ১৯৪৮ সালে 'কার বাঁশি বাজে' দিয়ে তিনি পুজোর গান শুরু করেছিলেন।
 
পুজোর গান বলতেই মনে পড়ে মহালয়ের কথা। যতদিন মহালয়া থাকবে, মহিষাসুরমর্দিনী থাকবে, দুর্গা পুজো থাকবে, আশ্বিন থাকবে, ততদিন থাকবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়... আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী...
 
মহিষাসুরমর্দিনী'র দ্বিতীয় গানটি ভৈরব রাগে। সংগীত-আয়োজনে করেছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। সমবেত সঙ্গীতে ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শিপ্রা বসু, সুপ্রীতি ঘোষ, শ্যামল মিত্র, সত্য চৌধুরী, বিমলভূষণ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তালাত মামুদ উৎপলা সেন, রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু, আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রমুখ।বিমানে বিমানে আলোকের গানে জাগিল ধ্বনি গানটি শোনা যায় তাঁর কণ্ঠে। দুর্গা পুজোর পরে বাংলার সেরা পুজো হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো।
 
 
sandhyamukherjee2
 
 
লক্ষ্মী পুজো মানেই প্রতিটি ঘরে ঘরে একটাই গান, 'শঙ্খ বাজিয়ে মা কে ঘরে এনেছি। এস মা লক্ষ্মী বসো ঘরে।' ৭০-এর দশকে পুজর গানের রমরমায় এই গান সেই সময়ের অন্যত সেরা হিট ছিল। তাঁর গান, সুর ও কণ্ঠ মোহিত করেছে বাংলার আপামর শ্রোতাদের। কালজয়ী বাংলা গানের অফুরন্ত ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ করেছেন বাঙালিদের।
 
এ শুধু গা্নের দিন এ লগনও গান শোনাবার, ১৯৫৭ সালের বাংলার চিরন্তন উত্তম-সুচিত্রা জুটি অভিনীত আগ্রদূতের পরিচালনায় 'পথে হল দেরি' চলচ্চিত্রের এই গানটি এখনও সমান ভাবে আকর্ষণীয় শ্রোতাদের কাছে। গানের কথা লিখেছিলেন প্রখ্যাত লেখক তথা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সঙ্গীত পরিচালক রবিন চট্টোপাধ্যায়
 
হেমন্তের সঙ্গে তাঁর জুটি অমর হয়ে রয়েছে। তিনি গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ওঁদের জুটি যেন গানের উত্তম-সুচিত্রার জুটি! 'এ শুধু গানের দিন এ লগন গান শোনাবার' গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় রবিন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় 'পথে হল দেরি' ছায়াছবির জন্য গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই সময় রোমান্টিক ডুয়েট মানেই গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই জনারেই ফের গাইলেন।
 
আবারও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় অজয় করের পরিচালনায় 'সপ্তপদী' ছবির 'এই পথ যদি না শেষ হয়' গাইলেন। উত্তম-সুচিত্রা বাইকে চলেছেন, বাংলা রোমান্টিক গানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এই গান। গানটি আজও বাঙালিকে আবেগ তাড়িত করে, বাঙালির চিরপ্রেমের গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কালজয়ী গান 'এই পথ যদি না শেষ হয়'।
 
১৯৬১ সাল দুপুরের খেয়ে উঠেছেন সবে, জোর করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্টুডিও তে ধরে আনলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে, এই পথ যদি না শেষ হয়-তে 'লালালালা' আর তুমিও বলো বলানোর জন্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অন্যতম সুপারহিট গান 'রাগ যে তোমার মিষ্টি ওগো অনুরাগের চেয়ে'। ১৯৬৯ সালের জুবিলি হিট এই সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন স্বরূপ দত্ত ও তনুজা। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পবিত্র চট্টোপাধ্যায়।১৯৫৪ সালে মুক্তি পেল 'অগ্নি পরীক্ষা', মহানায়ক উত্তম কুমার ও মহানায়িকা সুচিত্রা সেন অভিনীত এই ছবির প্রতিটি গানই অমর হয়ে রয়েছে। তারই মধ্যে 'গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু আজ স্বপ্ন ছড়াতে চায়' গানটি লিখেছেন গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর দিয়েছেন অনুপম ঘটক। আর কণ্ঠে সন্ধ্যা।
 
 
sandhyamukherjee3
 
 
আধুনিক বাংলা গানে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছিলেন অনন্য, মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা এক অনবদ্য সৃষ্টি। উত্তম কুমার ও অপর্ণা সেন অভিনীত চলচ্চিত্র 'জয় জয়ন্তি' সিনেমার চির সবুজ গান আমাদের ছুটি ছুটি চল নেবো লুটি ওই আনান্দ ঝর্ণা। এই গানের জন্য ১৯৭১ সালে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গানের লেখক শ্যামল গুপ্ত এবং সুরকার আরও এক প্রখ্যাত শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
 
বাংলার দুই কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যৌথ সঙ্গীতের মধ্যে একটি হল 'অ্যান্টেনি ফিরিঙ্গী' ছবির গান চম্পা চামেলি। উত্তম কুমার তনুজা অভিনীত সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ১৯৬৭ সালের এই সিনেমায় অভিনয় করার জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মহানায়ক। গানের সুরকার ছিলেন অনিল বাগচি। উত্তমের নায়িকাদের বরাবরের কণ্ঠ হয়েছেন সন্ধ্যা।
 
মহানায়ক উত্তম কুমার ও অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত সুপারহিট ফিল্ম 'নায়িকা সংবাদ'। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গান কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল কে যেন ডাকে বারে বারে।
 
উত্তম কুমার তনুজা অভিনীত সিনেমা 'দেয়া নেয়া'তে একটি গানই গেয়েছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আর সেই গানটিই পরবর্তীতে এই ছবির সেরা গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়। 'এ গানে প্রজাপতি পাখায় পাখায় রঙ ছড়ায়'
 
সন্ধ্যার চলচ্চিত্রের গানের কথা লিখতেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। ​গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে মিলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ।
 
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্য বাঙালি শিল্পীরা গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষ্যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে' গানটি মুক্তি পায়। প্রশ্নাতীত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল গানটি।
 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে, প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন উপলক্ষ্যে ঢাকায় পল্টন ময়দানে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন  সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
 
বাংলা গানের এতো রত্ন রেখে সন্ধ্যা পাড়ি দিলেন ওপারে। যত দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে এই ভুবন মোহিনী কণ্ঠ অমর থেকে যাবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...