ঋকবেদের দশম মণ্ডলের পঁচানব্বইতম সূক্তটি রচনা করেছিলেন এই নারী। তিনি ঊর্বশী। সুন্দরী, বুদ্ধিমান, বিদূষী। কিন্তু নিজের কথার ব্যাপারে সব সময় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকতেন। একবার কোনো কথা দিলে তা জীবন দিয়ে হলেও পালন করতেন।
ঊর্বশীকে নিয়ে মহাকাব্য ও পুরাণে নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। বৈদিক যুগের নারী হিসেবে ঊর্বশী অনন্যা। ইতিহাসের পাতায় তাঁর স্থান স্থায়ী। পুরাণ এবং মহাকাব্যগুলি থেকে বিভিন্ন অপ্সরার নাম পাওয়া যায়। ঊর্বশী তাদের মধ্যে অন্যতম। পুরাণে মহাকাব্যের বর্ণনা উর্বশীকে রহস্যময়ী হিসেবে উপস্থাপিত করে। ঊর্বশী শব্দটির জন্ম উরু থেকে। ‘দেবী ভাগবত’ অনুসারে ঊর্বশীর জন্ম হয়েছিল ভগবান নারায়ণের উরু থেকে।
‘ভাগবত পুরাণ’ অনুযায়ী একসময় ধর্ম রক্ষার জন্য ভগবান বিষ্ণু নর ও নারায়ণ নামের দুই পুরুষের অবতারের অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এই দুই পুরুষ কঠিন ব্রত ধারণ করে তপস্যা শুরু করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁদের এই তপস্যায় চিন্তিত হয়ে পড়েন। তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তিনি কামদেব ঋতুরাজ বসন্ত এবং অপ্সরাদের পাঠান। তিনি জানতেন না যাঁরা তপস্যা করছেন তাঁরা আসলে দেবতা। নারায়ণ ইন্দ্রের এই কাজে বিরক্ত হয়ে একটি ফুল নিয়ে তাঁর উরুতে রাখেন। সেখান থেকেই জন্ম হয় পরমা সুন্দরী অপ্সরা ঊর্বশীর। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর ভুল বুঝতে পারেন।
দেবতারা সবসময় দেবত্ব লাভের জন্যই তপস্যা করেন না, সাধনা করার মানসিকতাও তাঁদের তপস্যয় ব্রতী করতে পারে। দেবরাজ ইন্দ্র উপলব্ধি করতে পারেন এই সত্য। নারায়ণ উর্বশীর জন্মের পর তাঁকে ইন্দ্রের হাতে সমর্পণ করেন। ঊর্বশী ইন্দ্রের সভার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অপ্সরা হিসেবেই থাকতেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন এই উর্বশী এবং ঋষি উর্বশী আসলে একই।
উর্বশীকে নিয়ে পুরাণে মহাকাব্যের অনেক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনীটি হল তাঁর সঙ্গে চন্দ্রবংশীয় রাজা পুরুরবার ভালোবাসার কাহিনী। ঊর্বশী যে সূক্তগুলি রচনা করেছিলেন তা আসলে তাঁর আর পুরুরবার কথোপকথন। তাঁদের প্রেম কাহিনীকেই বেদের সূক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ঊর্বশী পুরুরবাকে বিয়ের সময় তিনটি শর্ত দিয়েছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিল পুরুরবা ঊর্বশীর পোষ্য মেষকে রক্ষা করবেন এবং তাঁরা ঘনিষ্ঠতায় ছাড়া পরস্পরকে বস্ত্রহীন দেখবেন না। পুরুরবা ও ঊর্বশীর দাম্পত্য জীবন বেশ সুখকর ছিল।
ঊর্বশী ইন্দ্রের সভা থেকে চলে যাওয়ায় দেবরাজ ইন্দ্র অসন্তুষ্ট হন। তিনি উর্বশী ও পুরুরবার বিচ্ছেদ ঘটানোর জন্য উপায় খুঁজতে থাকেন। তাঁর নির্দেশে কয়েকজন গন্ধর্ব পুরুরবা ও ঊর্বশীর মিলনের সময় তাদের পোষ্য মেষকে চুরি করেন। মেষের ডাকে ঊর্বশী বুঝতে পারে কেউ তাকে হরণ করেছে।
এমন সময় পুরুরবা নগ্ন অবস্থাতেই মেষ উদ্ধারে দৌড়ে যান। মেষ উদ্ধার করে ফিরে আসছিলেন পুরুরবা। এমন সময় ইন্দ্র বজ্রপাত ঘটান। এই বজ্রপাতের আলোয় পুরুরবাকে বস্ত্রহীন অবস্থায় দেখতে পান উর্বশী। শর্ত ভঙ্গ হয়। দেবরাজকে ছেড়ে স্বর্গে চলে যেতে বাধ্য হন ঊর্বশী।
স্বামী পুরুরবা উর্বশীকে ভালবাসতেন। বারবার তাঁর ডাকে উর্বশী মর্ত্যে ফিরে এসেছেন। কিন্তু কখনোই স্বামীর সঙ্গে আর থাকেননি। স্বামীর সঙ্গে সংসার করাকালীন তিনি ঋকবেদ চর্চায় মন দিয়েছিলেন। ঋগ্বেদ চর্চা তাঁকে জীবনে প্রকৃত আনন্দের অর্থ চেনায়।
ঋগ্বেদ অনুযায়ী অপ্সরা শব্দের অর্থ ব্যাপক যে রূপ বা অনন্যস্বরূপা। এখানে রূপ বা সৌন্দর্য অর্থে বৃহৎ আনন্দকে বোঝানো হয়। বৃহৎ আনন্দের কামনা করাকে ঊর্বশী তাঁর রচিত সূক্ততে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নিজের কাজের মাধ্যমেই এই নারী অনন্যা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন।
ছবি প্রতীকী