বাবার কাছে বারবার বিবাহের মন্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাইছিলেন মেয়ে। বাবা যথেষ্ট জ্ঞানী-গুণী মানুষ। ঋষি সবিত্র। কিন্তু মেয়েকে বিবাহের মন্ত্রের গূঢ় অর্থ সম্বন্ধে বোঝাতে অপারগ ছিলেন বাবা। তখনো তেমনভাবে বিবাহের মন্ত্রের প্রচলন শুরু হয়নি। যেটুকু আচার পালন করা হতো, তা বৈদিক সমাজের স্থির করে দেওয়া নিয়ম। বিবাহের মন্ত্র নিয়েই সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন মেয়ে।
নানা বিষয়ে মেয়ের কৌতূহল বাবাকে মেয়ের পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখতে বাধ্য করে। মেয়েটি বেদচর্চায় মন দেয়। এতটাই মন দেয় যে বিবাহের মন্ত্র রচনা করা শুরু করেন এই বৈদিক নারী। তিনি সূর্যা। ঋষি সূর্যা।
বৈদিক সমাজে যে সমস্ত নারীরা বিদ্যাচর্চার জন্য বিশেষ স্থান লাভ করেছেন ইতিহাসে, সূর্যা তাঁদের মধ্যেই একজন। তিনি সার্থকনামা। সূর্যের মতোই তেজ ছিল তাঁর। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতেন না। যা সঠিক, যা সম্মানীয় তার কথা সোচ্চারে বলতেন এই নারী।
বিয়ের মন্ত্র নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন। সেভাবে বিয়ের মন্ত্র উচ্চারণের রীতিনীতি তখনো চালু হয়নি। যতটুকু শুরু হয়েছিল তাতে একেবারেই সন্তুষ্ট ছিলেন না এই ঋষিকা। তাই নিজেই বিয়ের মন্ত্র রচনা করা শুরু করেছিলেন। বৈদিক সমাজে সেই সকল মন্ত্র গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
ঋকবেদে উল্লেখিত অন্যতম বিদেশি এই ঋষি সূর্যা। পিতা সবিত্র তাঁকে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। মূলত বাবার কারণেই এই বেদচর্চায় আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের পঁচাশিতম সূক্তে এই মহান নারীর উল্লেখ রয়েছে। বিয়ের অনেক মন্ত্রের রচয়িতা এই ঋষিকা।
এমনকী বিবাহ পরবর্তী জীবনে বিশেষ করে সংসার জীবনে নারীর সম্মান ও মর্যাদার অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় ঋষি সূর্যার মন্ত্রে।।
ঋষি সূর্যার মন্ত্র আসলে বিয়ের ভেতর যে শুভ সংস্কার থাকে তার কথা বলে। বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া আচার-রীতি-নীতির উর্ধ্বে গিয়ে যৌথ যাপনের কথা বলে।
এই ঋষির মন্ত্র জীবন-ধর্মের। অধ্যয়ন, অধ্যাপনার মন্ত্র। ঋষিকা সূর্যার মন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই বিবাহ জীবনে যৌথযাপন ও জীবন ধারণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রীতি-নীতির থেকেও স্বামী-স্ত্রীর ভালো থাকা ও স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আবার এই বৈদিক সমাজেই প্রচলিত দৃষ্টিতে বৈধব্যকে হিন্দু নারীর পালনীয় সংস্কার হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্বামীরও যজ্ঞের অধিকার হারানোর কথা বলা হয়েছে।
ঋষি সূর্যার মন্ত্রে বৈধব্যকে স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের পালনের কথা বলা হয়েছে। বৈধব্য স্বামী, স্ত্রী দুজনের কাছেই পালনীয় সংস্কার। সূর্যার রচিত মন্ত্রে হিন্দু ধর্মের অন্যতম কাঠামো তৈরি হয়েছে। যে মন্ত্র সর্বাধিকার দান, সর্বগ্রহণ ও সর্বায়ত এই তিনটি চেতনা দিয়ে তৈরি।
এই চেতনা এক নয় বহুর কথা বলে। ঋগ্বেদের সময়ে এমন বহু সংস্কারের ঊর্ধ্বে শুধুমাত্র জীবনের কথা বলা হয়েছে।
বৈদিক সমাজে যে সমস্ত নারীরা তাঁদের কীর্তির মাধ্যমে নিজেদের বিশেষ জায়গা করে নিয়েছেন ঋষিকা সূর্যা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমান যুগের বহু কুসংস্কার ভাঙার পথ গড়ে দিয়েছিলেন এই সকল নারীরাই। এই নারীরাই প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েও সত্য ও ন্যায়ের পথ প্রতিষ্ঠা করতে শিখিয়েছিলেন।