ঋগ্বেদ নিয়ে চর্চা করছেন বাবা। নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন তিনি। একাগ্রতা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। স্ত্রী, কন্যার কথাও মনে থাকে না। বেদ চর্চা আসলে তাঁর সাধনার ধন। আপন খেয়ালে তিনি রচনা করে চলেছেন সূক্ত।
স্ত্রী কখনো বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে টানছে বাবার এই একাগ্রতা। পরম মমতায় সে বাবার কাছে খাবার পৌঁছে দেয়। কখনো বাবাকে স্নানের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাবা যে সপ্ত ঋষির একজন। ঋষি অঙ্গিরা। আর কন্যা শাশ্বতী ছিলেন মেধাবিনী ঋষিকা।
ঋষিকা শাশ্বতীর সম্পূর্ণ নাম শাশ্বতী অঙ্গিরর্সী। তিনি ঋষি অঙ্গীরার কন্যা এবং ঋষি অসঙ্গের সহধর্মিনী। ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের প্রথম সূক্তের ঋষি হিসেবে এই বিদুষী নারী বিখ্যাত।
অঙ্গীরা হিন্দু ধর্মের একজন বৈদিক ঋষি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। ঋকবেদে তাঁকে ঐশ্বরিক জ্ঞানের শিক্ষক, পুরুষ ও দেবতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য স্তোত্রে অগ্নি-দেবতার প্রথম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি অঙ্গীরাস ও অঙ্গিরা উভয় নামেই পরিচিত।
কিছু ঐতিহাসিক তাকে সাত মহান ঋষি বা সপ্তর্ষিদের একজন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অনেক গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লেখ থাকলেও তাঁকে সাত ঋষির সঙ্গে গণনা করা হয়নি। অনেক ঐতিহাসিক অঙ্গিরার ছাত্রদের অঙ্গিরাস বলেন।
মহান ঋষি অঙ্গীরার কন্যা শাশ্বতী। ছোট থেকেই বুদ্ধিমতী, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী ছিলেন শাশ্বতী। অঙ্গিরাকে অনেক সময়ই ব্রম্ভর্ষিও বলা হত। অগ্নিদেবের সঙ্গে বারবার কলহ লেগেছে এই ঋষির। শেষ পর্যন্ত অগ্নিদেবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল এই ঋষিকে।
ঋক বেদের অনেক সূক্ত রচনা করেছিলেন এই ঋষি। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন স্নেহশীল পিতা। যে সময়ও যৌতুক প্রথা বা কন্যা-পণের প্রথা ছিল। ঋষি অঙ্গীরার কন্যার বিবাহের সময় কন্যাপণ দেননি।
ঋষি অঙ্গীরা চেয়েছিলেন তাঁর কন্যা বিয়ের পর বাবার কাছেই থাকুক। ঋষি অসঙ্গর সঙ্গে বিয়ে হয় শাশ্বতীর। স্বামী সহানুভূতিশীল ছিলেন শাশ্বতীর ইচ্ছের প্রতি। তাই ঋগ্বেদের সূক্ত রচনা করার ক্ষেত্রে স্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বৈদিক সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে নারীর অধিকার সমাজে উপেক্ষিত। আবার কিছু ক্ষেত্রে সেই নারী তাঁর মেধার আলোয় উজ্জ্বল করেছে বৈদিক সমাজকে। শাশ্বতী তেমনই এক নারী।
বৈদিক যুগের কিছুটা সময় পুরুষতান্ত্রিক। কিছু ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক বৈদিক সমাজে যজ্ঞ ছিল অন্যতম ধর্মীয় কাজ। যজ্ঞে নারীর ভূমিকা কিছু ছিল না।। যজ্ঞে পুরুষ জজমানের ভূমিকা ছিল প্রধান। নারীর উপনয়ন নেই বলে নারী হোম করতে পারতেন না। কিন্তু শাশ্বতী ছিলেন ছকভাঙ্গা নারী। তিনি যজ্ঞ করেছিলেন।
বৈদিক সমাজে পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকারও উদাহরণ পাওয়া গেছে। স্ত্রীদের শাসনে রাখার মন্ত্র রয়েছে বেদে। যদিও আদি বৈদিক সমাজে নারীরও একাধিক বিবাহের কথা জানা যায়। কিন্তু সে খুবই অল্প সময়ের জন্য। শাশ্বতী ঋষি অসঙ্গকে বিয়ে করলেও বৈদিক সমাজের পুরুষতন্ত্রকে হেলায় উপেক্ষা করেছেন। তাঁর স্বামী তাঁর প্রতি ভালোবাসায় অনুরক্ত ছিলেন। শাশ্বতী বৈদিক সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মকে মানতে চাননি, তার জন্য প্রয়োজনীয় লড়াইও করেছেন।
বৈদিক সমাজের এই মেধাবিনীরা নিঃসন্দেহে একটা আলোর পথ প্রস্তুত করেছিলেন আজকের নারীদের জন্য।