দেবী সূক্তমের রচয়িতা ঋষিকা বাক। ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক। ছোটবেলা থেকেই বুদ্ধিমতী ও বিদূষী ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা ছিলেন মহর্ষি। বাবার কাছ থেকেই বেদ নিয়ে কাজ করার শিক্ষা। সেই কাজকে সাধনার মত করে আপন করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, দেবী সূক্তম রচনার জন্যে তাঁর অধ্যাবসায় অবাক করেছিল তাঁর বাবাকেও।
নিজের গরজেই বাবার কাছে স্তোত্র রচনা শিখেছিলেন তিনি। প্রতিদিন নিয়ম করে শিক্ষাদান চলত। প্রথমবার যখন নিজে স্তোত্র রচনা করে বাবাকে দেখিয়েছিলেন, বাবার চোখে জল। বাবা যে আসলে তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে দেবী মাহাত্ম্যে শ্রীশ্রী চন্ডীতে একাদশ অধ্যায়ের একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে "স্ত্রীয়ঃ সমস্ত সকলা জগৎসু" প্রত্যেক চতুর্ষষ্ঠী কলা-যুক্তা স্ত্রী বা নারীর মধ্যেই দেবী সত্তা বর্তমান। যে দেবী সত্তা জগতের আধার। ঋষি, অম্ভৃণের কন্যা বাক সেই আদ্যা শক্তি দেবীর স্বরূপ বিবরণ করেছিলেন তাঁর দেবী সূক্তম স্তোত্রের মাধ্যমে। বাক নিজেকেও এই শক্তির সঙ্গে একাত্ম করতে পেরেছেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে যে ব্রম্ভকে জ্ঞাত হয় তাকেই ব্রহ্ম স্বরূপ বলা হয়। ঋষিকা বাক আসলে ই এই স্তোত্র রচনার মাধ্যমে আদ্যা শক্তি দেবীর স্বরূপ নিজের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই তাঁকে ব্রহ্মস্বরূপাও বলা হয়।
মহর্ষি অম্ভৃণ কন্যা ব্রম্ভবিদূষী বাক অষ্ট-শ্লোকের সুক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকা। বেদের মন্ত্র আসলে অপৌরুষেয়। এই সুক্তমকে বাকসূক্ত বলা হয়। ঋগ্বেদের দশম মন্ডল দশম অনুবাকের একশতপঁচিশতম সূক্ত থেকে এটি গৃহীত হয়েছে। এই সূক্তকে বাকসুক্ত বলে।
দেবী সুক্তে নির্দিষ্ট করে কোন নাম বা উপাধি বিশিষ্ট দেবীর কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ এখানে আদ্যাশক্তিকে নির্দিষ্ট কোন রূপেই সীমাবদ্ধ করা নেই। এটিতে দেবীর বিশ্বময় স্বরূপের ব্যাপ্তি প্রকাশ পায়। এই দেবীশক্তির আরাধ্যা পরম ব্রম্ভ। যিনি নিরাকার ও সাকার উভয়ই।
সেই নিরাকার বিশ্বময় দেবী শক্তির স্বরূপ চন্ডিতে প্রপঞ্চিত হয়ে ত্রিগুণার্তিকা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর শুরু হয়েছিল সৃষ্টির স্পন্দন। শাক্ত মতে দেবীর সেই ব্রম্ভ আর বাক সেই দেবী সত্তা লাভ করে নিজেকে জগৎ এবং দেবশক্তির সঙ্গে অভিন্ন ঘোষণা করেছেন।
অম্ভৃণ-কন্যা বাক ছিলেন সাধিকা নারী। ব্রম্ভস্বরূপে উপনীত হওয়াতে তাঁর দেহাত্মবোধ বিনষ্ট হয়ে একমাত্র সোহম ভাব বর্তমান তার মধ্যে। তাই তার অষ্টশ্লোকী সূক্তটি উজ্জ্বল, লিঙ্গ, জাত এবং বর্ণের ঊর্ধ্বে।
শক্তির উপাস্য দেবী, পুরুষ, প্রকৃতি উভয় সেই জন্য দেবীকে শিবশক্তি ঐক্যরূপিনী বলা হয়। এই সকল কিছুই বাক নিজের অন্তরে উপলব্ধি করেছেন তাই পরম তত্ত্বের সৃষ্টি করেছেন তিনি।
বাক ঋকবেদের দশমন্ডলের দশম অনুবাগের একশতপঁচিশতমতম সূক্তের দ্রষ্টা। এতে মোট আটটি মন্ত্র রয়েছে। প্রথম এবং তৃতীয় থেকে অষ্টম মন্ত্র ত্রিষ্টুপ ছন্দে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রটি জগতী ছন্দে রচিত। এই শক্তির মন্ত্রগুলোকে একত্রে বৈদিক দেবীসূক্তম বলে। বাকের নাম অনুসারে বাকসূক্তম বলা হয়।
এই নারী বিদূষী এবং অনন্যসাধারণ ছিলেন, তাঁর গুণ সে যুগেও সমাদৃত হয়েছে।