মেঘলা দিনের মতো জীবন ছিল যে নারীর-সিদ্ধার্থ-পত্নী যশোধরা

শোনা যায় যে বৈশাখী পূর্ণিমায় কপিলাবস্তু থেকে নিজের বাপের বাড়ি যাওয়ার পথে লুম্বিনী নামের একটি বাগানে মায়া দেবী গৌতম বুদ্ধ অর্থাৎ সিদ্ধার্থকে জন্ম দেন। শোনা যায় ওই দিনেই আরও মানব-মানবীর জন্ম হয়েছিল ওই সময়ে। তার মধ্যেই অন্যতমা যশোধরা। এই কন্যা মেঘলা দিনের মত শান্ত, স্থির, অথচ আলো জমা করে রাখার মত আধার ছিল তাঁর।

ঐতিহাসিকরা বলেন এই জগতে এই নারী তাঁর পরিচয় গড়েছেন অনেকটাই স্বামীর কারণে। গৌতম বুদ্ধের স্ত্রী যশোধরাকে তবুও শুধুমাত্র সিদ্ধার্থের স্ত্রী হিসেবে অবহেলা করা যায় না। মেঘলা দিনের মত তাঁর জীবন হলেও উপেক্ষা করা যায় না তাঁর জীবনের সত্যতাকে।

এই অসাধারণ নারী কিন্তু স্বামীর প্রভাবে নিজের জীবনকে বদলেছেন ধীরে ধীরে। নিজের স্বামী সম্পর্কে বলেছেন "যেকোনো রাজা অপেক্ষায় তাঁর স্বামী অধিক বরেণ্য।" স্বামী সুখ সেভাবে মেলেনি জীবনে। তবুও মুক্ত মনে স্বামীর প্রশংসা করেছেন। নিজের মহিমায় তিনি উজ্জ্বল।

শাক্য সিংহ গৌতম-এর স্ত্রী ও রাহুলের মা যশোধরা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে উপেক্ষিতা। সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁর নাম। বৌদ্ধদের প্রাচীন সাহিত্যের তাঁর উল্লেখ নেই সেভাবে। কিন্তু পরবর্তী যুগের সাহিত্যে তিনি যথেষ্ট বন্দিতা হয়েছেন। কোথাও তাঁকে যশোধরা কোথাও গোপা, কোথাও ভদ্রকাঞ্চনা, বিম্বা, বিম্বা-সুন্দরী অথবা সুভদ্রকা নামে ডাকা হয়েছে।

গৌতম বুদ্ধের বিবাহ হয়েছিল তাঁর ষোল বছর বয়সে। তাঁর বাবা শুদ্ধোদন ছেলের শিক্ষা সম্পন্ন হলেই বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হন। অনেক দেখাশোনা করেই তিনি দণ্ডপাণির মেয়েকে নিজের ভাবী পুত্রবধু হিসেবে মনোনীত করেন। যশোধরা সুন্দরী ছিলেন। বৌমা হিসেবে পছন্দ হয়েছিল শুদ্ধোদনের। কিন্তু ছেলের মনের কথা জানা হয়নি। সেই ইচ্ছের কথা জানার জন্য বাবা একটি বিশেষ অভ্যর্থনা সভার আয়োজন করেছিলেন। এই সভায় সকলকে বিশেষ সামগ্রী উপহার দিচ্ছিলেন গৌতম। যশোধরাও উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। তিনি যখন গৌতমের কাছে এলেন, সামগ্রী শেষ। যশোধরা বিমর্ষ। তিনি গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন "আমি কি এমন অপরাধ করেছি যার জন্য আপনি আমায় এভাবে বঞ্চিত করলেন?" সিদ্ধার্থ তখন নিজের হাতের একটি আংটি পরিয়ে দেন যশোধরাকে।

সিদ্ধার্থ ও যশোধরা পছন্দ করেছিলেন একে অপরকে। কিন্তু রাজি ছিলেন না যশোধরার বাবা। শুদ্ধোদনের পুত্র সুন্দর, রূপবান। কিন্তু ধনুর্বিদ্যা, মল্লক্রীড়া এই সকল বিদ্যায় তাঁর কোন পারদর্শিতা নাকি ছিল না। তাহলে বিয়ে করে স্ত্রীকে রক্ষা করবেন কীভাবে? তাই বিয়েতে আপত্তি জানিয়েছিলেন শুদ্ধোদন। এদিকে এই কথা গৌতমের কানেও যায়। এর সাত দিন পরে কপিলাবস্তু নগরে একটি বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। শাক্যসিংহ সিদ্ধার্থ সেই জনসভায় নিজের রণকৌশল প্রদর্শন করেছিলেন। পরের দিনই স্থির হয় তাঁদের বিয়ে।

বিয়ের পর অনেক বছর ধরে যশোধরা স্বামীর সঙ্গে সংসার করেছিলেন। কিন্তু সেই সংসার করার দিনগুলি ছিল নেহাতই মেঘের মতো। সিদ্ধার্থের হৃদয়ের পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়। জাগতিক মোহ, মায়া, বাসনা, কামনা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি লাভ করতে থাকেন তিনি।

আষাঢ়ের এক পূর্ণিমায় তাঁর দেখা হয়েছিল এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। সন্ন্যাসজীবনের তৃপ্তির কথা শুনে তিনি নিজের জীবনের সত্যিকারের পথের সন্ধান খুঁজে পেয়েছিলেন।

ঠিক করেছিলেন সাংসারিক বন্ধন ছিন্ন করবেন। তখনই জন্ম নেয় তাঁর সন্তান। চলে যাওয়ার আগে শেষ বেলায় স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল তাঁর। যশোধরা তখন সন্তান জন্ম দিয়ে ক্লান্ত। নিদ্রায় আচ্ছন্ন। স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে রেখে সিদ্ধান্ত চলে যান তাঁর সন্ন্যাস-জীবনের পথে।

স্বামীর গৃহত্যাগ যশোধরাকে ব্যথিত করেছিল। স্বামী গেরুয়া বস্ত্র পরিধান করতেন শুনেছিলেন যশোধরা। তিনিও শুরু করেন গেরুয়া বস্ত্র পরা। স্বামীর সন্ন্যাসীবনের কথা শুনে নিজের যাবতীয় প্রসাধন-সামগ্রী, বিলাসিতা ত্যাগ করেছিলেন স্ত্রী। পালঙ্ক ছেড়ে মাটিতে শুতেন। বৈধব্যসম কঠিন ত্যাগ ও নিষ্ঠায় তিনি তার জীবনের মেঘলা দিন কাটিয়েছিলেন।

এরপর তিনি বাবার কাছে চলে যান। বোধগয়ায় বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে সাত বছর পর কপিলাবস্তুতে এসেছিলেন সাত দিনের জন্য। স্বামীর দর্শন পাওয়ার জন্য আলু-থালু চুলে অপলক চোখে যশোধরা দাঁড়িয়েছিলেন। অনুচর পরিবেষ্টিত গৌতম বুদ্ধ স্ত্রীর সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলতে পারেননি। যশোধরা সেদিন বুঝেছিলেন তাঁর স্বামী তার একার নেই, মেনে নিয়েছিলেন সেই জীবন। কিন্তু স্বামীর প্রতি অভিমানের সমুদ্র তার ভেতরে গর্জন করে চলেছিল অনবরত। তাই এরপর কোনদিন অভিমানে আর নিজের স্বামীর সামনে দাঁড়াননি।

তাঁদের সন্তান রাহুল বাবার কাছে পুত্রের অধিকার দাবি করেছিল মায়ের কথায়। গৌতম বুদ্ধ পরে তার উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন "রাহুলকে দীক্ষা দাও, এক সন্ন্যাসী তাঁর সন্তানকে এর চেয়ে বেশি আর কি দিতে পারে?" রাহুল চলে গিয়েছিল বাবার কাছে।

সংসারের সঙ্গে সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায় যশোধরার। তিনি নিজেও অবশেষে সন্ন্যাসের পথ বেছে নেন। ভিক্ষুণী-ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অন্তরকে সাধনায় নিমজ্জিত করেন। ভিক্ষুনী যশোদা নিজেকে সাধনার উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর দু'বছর আগে তাঁর দেহাবসান হয়। মৃত্যুর আগে শেষবার দেখা করেছিলেন স্বামীর সঙ্গে। কিন্তু তখন তিনি সাধিকা। নিজের সকল ইচ্ছে, বাসনা বিসর্জন দিয়ে সাধিকা রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন তিনি। তাই মেঘলা দিনের সমুদ্রের মতো অভিমান বয়ে বেড়িয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবন।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...