এক বিস্মৃতকালের কথা-বৈদিক যুগের মেধাবিনীরা

ভারতীয় আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ রচনার কাল সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মোটামুটি খৃষ্টের দশ-বারো কী পনেরো শতাব্দী অথবা তারও আগে, এ কথাও নিশ্চিত ভাবে বলা বেশ কঠিন। তবে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন যে নানা দেবতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ঋষি কর্তৃক রচিত মন্ত্র,স্তব, স্তুতি যা ঋগ্বেদে আছে তা কখনোই একই সময়ের রচনা নয়। দীর্ঘকাল ধরে রচনা করা হয়েছে সেই সব মূল্যবান পুঁথি।

যে সব ঋষিরা এইসব রচনা করতেন তাদের উত্তরপুরুষরা বংশানুক্রামিকভাবে তার ধারা বজায় রেখেছেন ‌। তবে উত্তর-পুরুষ শব্দটা ব্যবহার করা হলেও,  এই উত্তর-পুরুষের মধ্যে নারীরাও ভীষণভাবে ও নির্ভুলভাবে অন্তর্গত। পুরুষদের সমানে সমানে তারা সেই সকল মন্ত্র অত্যন্ত পবিত্রজ্ঞানে মনে রেখে রক্ষা করতেন। পরবর্তীকালে এই সব মন্ত্রকে ১০টি অসমান খন্ডে বা মন্ডলে সাজিয়ে একটি গ্রন্থের রূপ দেওয়া হয়েছিল। তাই বলা হয় ঋকবেদ দশটি মণ্ডলে বিভক্ত।

মূলত দেব-দেবীর উদ্দেশে  নিবেদিত হলেও ঋকবেদের মন্ত্রগুলি আসলে তৎকালীন ভারতের আর্যদের সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঋগ্বেদ আসলে আর্য সমাজের পুরুষ ও নারীর জীবনযাত্রায় আলো ফেলে। সেখানে আমরা দেখতে পাই গৃহে ও সমাজে দুই জায়গাতেই নারীর মর্যাদা ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। অবাধ স্বাধীনতা না থাকলেও পরবর্তী যুগের ভারতীয় নারীর থেকে তারা যথেষ্ট স্বাধীন ছিলেন সে সময়ে। বিয়ের পর নারী স্বামীগৃহে আসতেন, তারপর সেখানকার সর্বময় কর্ত্রী হয়েই সংসারজীবন যাপন করতেন। বাড়ির বাইরে যাতায়াত করার অবাধ অধিকার ছিল তাঁদের। এমনকি স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতিও ছিল। এই নারীদের মধ্যে কিছু নারী যথেষ্ট মেধাবিনী ছিলেন। তাঁদের কাজ ইতিহাসে তাঁদের আলোক উজ্জ্বল স্থান দিয়েছে।

সেই সময় মেয়েরা যৌবনে বিয়ে করত, তাও নিজের সম্মতিতে, নিজের ইচ্ছায়। এমনকি মেয়েরা নিজের া নিজেদের স্বামী খুঁজতেও বেরিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সেই সময় বাবা-মায়েরা তাদের কন্যা সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাই বলা যেতে পারে একটি সুশৃংখল ও সুষ্ঠু সমাজের অংশ ছিল প্রাচীন যুগের নারী। বিশেষ করে ঋকবেদের যুগের নারী।

ঋকবেদের যুগের নারীরা স্বয়ং ঋত্বিক সেজে যজ্ঞ    সম্পন্ন করার   অধিকারিণী ছিলেন। নিজেরা মন্ত্র রচনা করতেন। ঋকবেদে মন্ত্রগুলি সব পুরুষ রচিত নয়, অন্তত আটজন নারী রচিত মন্ত্র সেখানে স্থান পেয়েছে। যেমন ঘোষা, বিশ্ববারা, অপালা, গোধা, অগস্ত্য-ভগিনী, লোপামুদ্রা, শাশ্বতী ও রোমশা। এরা সকলেই সম্ভ্রান্ত
ঋষি পরিবারের মেয়ে ও স্ত্রী। প্রথমেই আজ ঘোষার কথা।

এই আটজন মন্ত্র-রচয়ত্রীর মধ্যে ঘোষার রচিত ঋক সবচেয়ে বেশি। ঋকবেদের দশম মণ্ডলে এই মন্ত্রগুলি পাওয়া যায়। প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত ঋষি বংশের মেয়ে ঘোষা। পিতার নাম কক্ষীবৎ ও পিতামহের নাম দীর্ঘতমস। ঘোষার পিতা এবং পিতামহের অনেক মন্ত্রই ঋকবেদে রয়েছে। এরা অশ্বী বা নাসত্য নামক দুই যমজ দেবতার উপাসক।

ঘোষাও এই দেবতাদের উপাসিকা। ঘোষা অত্যন্ত মেধাবিনী ছিলেন। কথিত আছে ঘোষার সর্ব-শরীর শ্বেতকুষ্ঠে আক্রান্ত হয়েছিল। অসুস্থ থাকাকালীন তিনি বাবার কাছে থাকতেন। প্রাচীন যুগে যে সকল মেয়েরা দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে থাকতেন তাদের অমাজুর বলা হত। ঘোষা দীর্ঘদিন এমন অমাজুর রূপে পিতৃগৃহে বাস করেছিলেন। তারপর এই অশ্বীদ্বয় দেবতার উপাসনা করে রোগমুক্ত হন। এই দেবতারা নাকি যৌবন ফিরিয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। ঘোষা যখন রোগমুক্ত হন তখন তিনি নাকি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছিলেন। যৌবন হারানো নারীর আকুতি শুনেছিলেন  অশ্বীদয় দেবতা। তারপর তাঁর বিয়ে হয় ও তিনি সন্তানের জননীও হয়েছিলেন। কথিত আছে তাঁর স্বামীর নাম অর্জুন। ঘোষার একটি রচনায় তাঁর পিতৃগৃহে কুমারী জীবন ও পরে সুখ সৌভাগ্য লাভের উল্লেখ পাওয়া যায়।

ঘোষার একটি মন্ত্রে বিপত্নীক স্বামীর স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও স্ত্রী হারানোর দুঃখের বিলাপ পাওয়া যায়। তাই কিছু ঐতিহাসিক বলেন ঘোষার স্বামী খুব বেশি দিনের জন্য সংসার-জীবনে পাননি ঘোষাকে। স্বামী-সুখ ও স্বাস্থ্য কামনার একটি মন্ত্র পাওয়া যায় ঘোষার রচনায়। ঘোষার পুত্রের নাম সুহস্ত্য। কিছু ঐতিহাসিক বলেন এই পুত্রের রচিত মন্ত্র ঋকবেদে রয়েছে। যদিও কিছু ঐতিহাসিক এই মন্ত্রকে তার এই মেধাবিনী মায়ের মন্ত্র হিসেবেই উল্লেখ করেন।

বৈদিক যুগের নারীরা নারীর জ্ঞানস্পৃহা ও বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ-দলিল। নারীর ইচ্ছেশক্তির কাছে যে অন্য যে কোনো শক্তি পরাজিত হয় তার সুস্পষ্ট দলিল ঋকবেদ। আজ এই সমস্ত নারীরা সেই সময়ের সমাজের উজ্জ্বল দিকটির দৃষ্টান্ত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...