Legendary Saga Of Vedic Women- Moitrayee

ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ী কীভাবে খোঁজে পেয়েছিলেন অমরত্বের পথ?

ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক্যের পত্নী ছিলেন মৈত্রেয়ী। পুরাণে এই ঋষির ধর্মপ্রাণ মনোভাব, তাঁর ঈশ্বরের প্রতি সাধনা বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এই ঋষির দুই পত্নী ছিলেন। কাত্যায়নী ও মৈত্রেয়ী।

সাংসারিক বিষয়ের ওপর মৈত্রেয়ী সাধারণত উদাসীন থাকতেন। নিজের বেদ চর্চা, ঈশ্বর সাধনা নিয়েই মেতে থাকতেন তিনি। যাজ্ঞ্যবল্ক্য আশ্চর্য হতেন মৈত্রেয়ীকে দেখে। সে সময়ও নারীদের সংসার, স্বামী, পরিবার এবং সাংসারিক নানা কাজের প্রতি আসক্তি ছিল। কর্তব্য ছিল এই পথেও। পড়াশোনার চর্চা করলেও সেটা নেহাতই শখে করা হতো। স্বামী, সন্তান সামলানোকেই মহিলাদের স্বাভাবিক কর্ম বলেই ধরে নেওয়া হতো তখন।

মৈত্রেয়ী ছিলেন এই ক্ষেত্রে অন্যরকম। তিনি ছিলেন ধর্মশীলা। ধ্যান, সাধনাতেই বিশেষভাবে সময় অতিবাহিত করতেন। স্বামীর সঙ্গে ব্রম্ভবিদ্যা আলোচনায় তিনি আনন্দ লাভ করতেন। কাত্যায়নী কিন্তু ছিলেন গৃহকর্মে নিপুণা, সাংসারিক দিকে নিখুঁত, স্বামীসেবাকেই মূল ধ্যান-জ্ঞান হিসেবে বিচার করতেন। পারিবারিক কাজকর্মে তাঁর শ্রম দিতেন।

ঋষি যাজ্ঞ্যবল্ক্য গৃহস্থাশ্রমেই থাকতেন। দুই স্ত্রীকে নিয়ে বেশ শান্তিতেই জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল তাঁর। একদিন তিনি ভাবলেন শাস্ত্র নির্দেশে তাঁর বাণপ্রস্থ গ্রহণ করার বয়স হয়েছে। সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে তিনি বাণপ্রস্থ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

তিনি জানতেন তাঁর এই দুই পত্নীর মধ্যে কোন বিরোধ নেই। তাই নিশ্চিন্তেই তিনি তাঁর সাধনায় মন দিতে চাইছিলেন। কিন্তু তবুও স্বামী হিসেবে স্ত্রীর সমস্ত দিকে নজর দোওয়া নিজের কর্তব্য বলে মনে করে ঋষি যাজ্ঞ্যবল্তাক্য তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দুই স্ত্রীর মধ্যে ভাগ করে দিতে চাইলেন। স্ত্রীরা তাঁর ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে কোন বাধা দেননি।

তিনি খুশি হয়ে বললেন "এবার আশ্রমের সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সময় এসেছে, আমি চাই আমার অনুপস্থিতিতে তোমাদের মধ্যে কোনরকম ঝগড়া অশান্তি যাতে না হয়, তাই সম্পত্তির সমবন্টনকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই।"

 কাত্যায়নী এই বিষয়ে নিরুত্তর রইলেন। স্বামীর আদেশকে শিরোধার্য মনে করে মেনে নিলেন সবটা। কিন্তু যে নারী ওই সময় দাঁড়িয়েও প্রশ্ন করেছিলেন তিনি মৈত্রেয়ী‌।

মৈত্রেয়ী স্বামীকে প্রশ্ন করেছিলেন "ভগবান আপনি যে ধনসম্পত্তির কথা বলছেন সে বিষয়ে আমি কিছু জানতে চাই, শুধু আপনার আশ্রমের ধন-সম্পত্তি কেন, এই সমুদ্র-মেঘলা সমগ্র পৃথিবী যদি ধনধান্যে পরিপূর্ণ হয় এবং আমার হয় তবে কি আমি সেই সকল কিছু দিয়ে অমর হতে পারব? কোনো পথেই কি আমি অমরত্ব লাভ করতে পারব?"

মৈত্রেয়ীর প্রশ্ন শুনে যাজ্ঞ্যবল্ক্য অবাক ও আনন্দিত হয়েছিলেন। স্ত্রীর এমন নির্লোভ ব্যবহার তাঁকে আশ্চর্য করেছিল। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন "মৈত্রেয়ী, তাও কি কখনো হয়? বিত্তের দ্বারা কখনও অমরত্ব লাভ করা যায় না,  বরং তা অমৃতত্ব সাধনায় বিঘ্ন তৈরি করে, কিন্তু জগতে বিত্তশালী ব্যক্তিরা যেমন অভাব-অনটন থেকে মুক্ত হয়ে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে তুমিও তা পারবে।"

স্বামীর উত্তরে মৈত্রেয়ী বিমর্ষ হন। তিনি বলেন "যা দিয়ে আমি অমৃতত্ব লাভ করতে পারবো না তা দিয়ে আমি কী করব? এই অসাড় ধন-সম্পত্তি দিয়ে আমার কী হবে? বরং আপনি যে ধন লাভ করে এই বিষয় সম্পত্তি পরিত্যাগ করছেন আপনি যে জ্ঞানে জ্ঞানী হয়েছেন দয়া করে আমায় সেই সম্বন্ধে উপদেশ দিন। আমায় অমরত্ব লাভের সন্ধান দিন।"

জীবনের প্রতি মোহ থেকে মৈত্রী এই কথা বলেননি। তিনি তাঁর অন্তরের সাধনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ধন, বিত্ত, স্বর্গ সবকিছুই উপেক্ষা করে জীবনের পথে ভালোবাসা খুঁজে অমরত্ব লাভের সন্ধান করেছেন।

বৈদিক যুগের মেধাবিনী নারীদের মধ্যে মৈত্রেয়ীর নাম সবার প্রথমেই আসে। মেধাবী, বিদূষী এই নারী তাঁর নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন নিজের গুণে। এই মৈত্রেয়ীর অনন্যতা ছিল তাঁর ভাবনায়।
বৈষয়িক ভাবনার বাইরে গিয়ে যে সাধনার ভাবনা তাঁকে চিরকাল আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই ভাবনাতেই তিনি মহীয়সী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ইতিহাসে।

তাঁর স্বামীও তাঁকে শেষ বেলায় বলেছিলেন "স্বামী যে স্ত্রীর প্রিয় হয়, তাঁর কারণ স্বামীকে ভালোবেসে স্ত্রীর আত্মা সুখী হয়, পুত্র-কন্যাকে স্নেহ করে বাৎসল্যরসে পিতা-মাতারা আত্মিক সুখ অনুভব করেন। এই কারণে ছেলেমেয়েরাও বাবা-মায়ের স্নেহে নিজের আত্মিক সুখ অনুভব করে। তাই সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার প্রতি অনুরক্ত থাকে। অর্থাৎ জীবনে সবকিছুই আত্মার তৃপ্তির জন্য হওয়া উচিত।। ধনলাভ নিজের আত্মশুদ্ধির জন্য করা উচিত। যে সম্পদ আত্মাকে শুদ্ধ করে, অন্তরকে তৃপ্ত করে সেই সম্পদই আমাদের বিত্ত। আত্মার সুখই মানুষের মুখ্য প্রীতির বস্তু।"

স্বামীর কথায় তৃপ্ত হয়েছিলেন মৈত্রেয়ী নিজেও। স্বামীর জ্ঞানকে আজীবন নিজের জীবনের পথে আঁকড়ে ধরেছিলেন। বৈদিক সমাজের মেধাবিনীদের মধ্যে তাই মৈত্রেয়ীর নাম নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...