আঠেরো দিনে শেষ হল কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ। কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল। শোকের পাহাড় জমল গান্ধারী আর ধৃতরাষ্ট্রের বুকে। তাঁদের মনে হল, এই যে দুর্বিষহ শোক, এর জন্য দায়ী কেবল কৃষ্ণ! হ্যাঁ, একমাত্র কৃষ্ণ! তাঁর প্ররোচনা ও পক্ষপাত না-থাকলে এই শোক তো তাঁদের জীবনে আসত না! ধৃতরাষ্ট্র যদিও বা এই পক্ষপাতী-প্ররোচককে ক্ষমা করেন, গান্ধারী কিছুতেই করবেন না। স্নেহান্ধ গান্ধারী এতদিন পুত্রদের অধর্ম দেখতে পাননি, এখন শোকে অন্ধ হয়ে ধর্মপথও দেখতে পেলেন না। অভিশাপ দিলেন কৃষ্ণকে। অকাট্য অভিশাপ। যেমন করে কৃষ্ণের কারণে জ্ঞাতিদ্বন্দ্বে কুরুবংশ শেষ হয়ে গেল, তেমন করেই আজ থেকে ছত্রিশ বছর পর ধ্বংস হবে যদুবংশ! হবেই!
গান্ধারী গুরুজন। মাতৃসমা। তাঁর কাছ থেকে প্রসাদের মতো অভিশাপ গ্রহণ করলেন কৃষ্ণ। মনে কোন দ্বেষ এল না, ক্ষোভ হল না; ধর্মপথ যদি তাঁর পাথেয় হয়, তবে, এ তো তাঁর প্রাপ্যই। অভিশাপ মাথায় নিয়ে কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলেন।
দ্বারকা। যাদব-রাজ্য। কৃষ্ণ-বলরাম সেখানকার রাজা। স্ত্রীপুত্রদের নিয়ে তাঁদের সুখের রাজত্ব। সুখসম্পদে কোথা থেকে কীভাবে যে কেটে গেল ছত্রিশটা বছর, টেরই পাওয়া গেল না। সুখের সময়ে প্রলয়কালের কথা মানুষের মনে থাকে না। কৃষ্ণেরও রইল না। কৃষ্ণ তো আসলেই নারায়ণের মানুষরূপী অবতার। তাই মানুষের তিনগুণই তো তাঁর মধ্যে বিরাজমান। স্মরণ-বিস্মরণ সব।
এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। দেবর্ষি নারদকে সঙ্গে নিয়ে একদিন মহর্ষি কণ্ব ও বিশ্বামিত্র কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দ্বারকায় এলেন। সাক্ষাৎ সেরে তিন ঋষি যখন অতিথিশালায় বিশ্রাম করছেন, তখন কৃষ্ণপুত্র যুবক শাম্ব, আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মতিচ্ছন্ন হল। তাদের দুর্বুদ্ধি হল, এই তিনজনকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, এরা কতবড় ঋষি! দুর্বুদ্ধি মাথায় চাপলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মাথায় খেলে গেল দুষ্টবুদ্ধি। ব্যস, মুহূর্তে শাম্বকে ঘাগরা-চোলি-গয়নাগাঁটি-ঘোমটা-ওড়না-আলতা-সিঁদুর-নূপুর পরিয়ে অন্তঃপুরের বউ সাজিয়ে ফেলল স্যাঙাতরা। পেটে কাপড় ঠুসে-বেঁধে গর্ভিনীও সাজিয়ে ফেলল। তারপর নিজেরা সখী সেজে বধূবেশী শাম্বকে নিয়ে হাজির হল ঋষিদের কাছে। তারা প্রণাম করল বটে, কিন্তু তাদের আচরণ ও কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঢাকা পড়ল না--হে ত্রিকালদর্শী ঋষিগণ, আপনাদের যদি ক্ষমতা থাকে বলুন তো এই গর্ভিনী কেমন সন্তান প্রসব করবে?
ঋষিরা তো তাদের স্পর্ধা দেখে অবাক! তাঁরা দিব্যদৃষ্টিতে স্পষ্টই বুঝলেন কুলবধূর বেশে তাঁদের সামনে যাকে আনা হয়েছে, সে আর কেউ নয়, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব! তাঁদের মতো ত্রিকালদর্শী ঋষিদের সঙ্গে এমন জঘন্য রুচিহীন তামাশা! রাগে কেঁপে উঠলেন তাঁরা। কিন্তু, অবতার কৃষ্ণের কথা ভেবে তাঁরা রাগ প্রশমিত করতে চাইলেন। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া প্রবল অভিশাপকে সম্বরণ করতে চাইলেন। তাই তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নীরব রইলেন। কিন্তু, এতে শাম্বদের সাহস আরও বেড়ে গেল। বেপরোয়া হয়ে তারা হাসতে হাসতে বার বার বলতে লাগল, তোমরা যদি সত্যিই ত্রিকালদর্শী হও, তাহলে বলো এই গর্ভিনী কেমন সন্তান প্রসব করবে? বলো, বলো, বলো! নইলে বিদেয় হও!! আর সহ্য করা সম্ভব হল না। দুরন্ত রাগে কাঁপতে কাঁপতে ঋষিদের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো চরম অভিশাপ, ও মুষল প্রসব করবে! মুষল! লোহার মুষল! আর সেই মুষলের জন্যই যদুবংশ ধ্বংস হবে!--অভিশাপ দিয়েই প্রবল রাগে ঋষিরা দ্বারকা ত্যাগ করে চলে গেলেন। কিন্তু, শাম্বদের হাসি থামল না। ভণ্ড ঋষিদের ক্ষেপিয়ে দারুণ একটা তামাশা হল! শাম্ব যে পুরুষ সেটাই ব্যাটারা ধরতে পারল না, কোথাকার ত্রিকালদর্শী রে! লোহার মুষল--আবার মানুষে প্রসব করে নাকি! যত্তসব!
কিন্তু, ঋষিদের কথা মিথ্যে হল না। শাম্ব একদিন লোহার মুষল প্রসব করল। তাতে তার সঙ্গীরা সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল। পুরুষমানুষ যদি প্রসব করতে পারে, তাও আবার লোহার মুষল--তাহলে তো ঋষিদের অভিশাপে যদুবংশ-ধ্বংসের কথাও সত্য হতে বাধ্য! অমনি তারা আপদ ঘোচানোর জন্য মুষলটি চূর্ণবিচূর্ণ করে সমুদ্রে ফেলে দিল। কিন্তু, তাতে আসন্ন বিপদের প্রতিকার হল না। মুষল-প্রসবের পর থেকেই দ্বারকায় ধ্বংসের নানারকম দুর্লক্ষণ দেখা দিতে লাগল। যাদব-সমাজ যেন এলোমেলো হয়ে গেল। সমস্ত যাদব পুরুষ ও নারীদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিল। তারা তাদের পরমপূজনীয় কৃষ্ণকেও উপেক্ষা করতে শুরু করল। তাঁর সামনেই অকথাকুকথা বলতে লাগল, মদ্যপান করতে লাগল এবং কুরুক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার জন্য তাঁকে দোষ দিতে লাগল। এমনকি ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করতে লাগল। নীতি ও সদাচার বলে আর কিছু রইল না। রাতে মহাকালের ছায়া দেখা যেতে লাগল, ঘোড়ার পেটে গাধা, গাধার পেটে হাতি, নেউলের পেটে ইঁদুর, কুকুরের পেটে বেড়ালের জন্ম হতে লাগল, ত্রয়োদশীতে অমাবস্যা দেখা গেল--সমস্ত রাজ্যে যেন ধ্বংসের লক্ষণ ফুটে উঠতে লাগল! যাদবদের চারটি সম্প্রদায়--বৃষণী, কুক্কুর, ভোজ, অন্ধক। এই চার সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। মারামারি কাটাকাটি চলতে লাগল। সেই দ্বন্দ্বে একে একে মারা গেল কৃষ্ণের সব পুত্র-আত্মীয়রা। পুত্রশোক-আত্মীয়শোক বুকে নিয়ে কৃষ্ণ আর থাকতে পারলেন না। এই শোক দিনের পর দিন বয়ে চলা সম্ভব হল না। তখন এ-সবকিছুর অবসান ঘটাতে তিনি নিজেই তৎপর হলেন। তবু শেষ চেষ্টা করলেন সামদানে মত্ত যাদবদের নিরস্ত্র করতে। পারলেন না। কিছুতেই পারলেন না। তখন, আর উপায় না-দেখে এক গাছি তৃণ নিয়ে মন্ত্রবলে গড়ে তুললেন একটি লোহার মুষল। সেই মুষলের আঘাতে লড়াই-মত্ত, দুর্বৃত্ত ও অবাধ্য যাদবদের একে একে নিজের হাতে হত্যা করলেন। তখন পৃথিবী শান্ত হল। তিনি এবং বলরাম ছাড়া আর কোন পুরুষ রইলেন না যদুবংশে। চোখের সামনে সবাইকে শেষ হতে দেখলেন কৃষ্ণ। সে এক নিদারুণ যন্ত্রণার ক্ষণ! সবাই চলে গেল। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল কৃষ্ণের। এবার নিজেদের শেষ করতে হবে। তবেই যদুবংশ ধ্বংস হবে, গান্ধারীর অভিশাপ সত্য হবে! দাদা বলরাম কোথায়? তাঁকে তো দেখছি না! কোথায় তিনি!
বলরামকে খুঁজতে লাগলেন কৃষ্ণ। না, কক্ষে নেই, পুরীতে নেই। উপবনে নেই, বনে নেই। খুঁজতে খুঁজতে এলেন সমুদ্র তটে। দূরে যেন সমুদ্রের জলে ধ্যানস্থ কেউ বসে! এগিয়ে গেলেন তার দিকে। হ্যাঁ, এই তো দাদা! কাছে গিয়ে স্পর্শ করলেন দাদার দেহ। হ্যাঁ, দেহ। নিতান্তই দেহ। নিষ্প্রাণ দেহ! যোগ-বৈরাগ্যে প্রাণবিসর্জন দিয়েছেন বলরাম। তিনি মুক্ত হয়েছেন। নির্জন দ্বারকায় একা কৃষ্ণ। চরম একা। আজন্মসঙ্গী জ্যেষ্ঠ বলরাম, তিনিও চলে গেলেন! সব যেন শূন্য হয়ে গেল। শূন্য আকাশ, শূন্য বাতাস, শূন্য সংসার। এমন দুঃসময়ে যিনি জগতের রাজা, তাঁরও বুঝি চোখের জল আর স্মৃতি ছাড়া আর কিছু পাথেয় থাকে না! তাই চোখের জলে বিম্বিত হতে লাগল ফেলে আসা দিনের কত সুখস্মৃতি। কত উজ্জ্বল দিন। কত দীপমালা। আর এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি কখন সমুদ্রতীর ছেড়ে প্রবেশ করলেন বনের গহনে খেয়াল রইল না। বসলেন এক লতাবিতানে। তাও হুঁশ ফিরল না। হঠাৎ তাঁর সমস্ত আবেশ কেটে গেল। সমস্ত মায়ার কুয়াশা যেন এক নিমেষে একটা আলোর ফলায় ফালা ফালা হয়ে কেটে গেল। তাঁকে আমূল বিদ্ধ করল সুতীক্ষ্ণ করাল এক তির। এবার নিশ্চিত, শেষ হবে খেলা ভাঙার খেলা! এটাই তো হওয়ার ছিল! এর ভেতরেও যে এক গূঢ় রহস্য আছে! আছে অভিশাপসূত্র! সেই সূত্র আমাদের ধীরে ধীরে পৌঁছে দেবে জগন্নাথদেবের আবির্ভাব উৎসে। সে কথা শোনাব আগামিকাল, দ্বিতীয় পর্বে।