চলে গেলেন নারায়ণ দেবনাথ

মাঘের ৪ঠায় শেষ হয়ে গেলে আমাদের কিশোরবেলা। চলে গেলেন বনস্পতি। বাংলা কমিকসের প্রাণপুরুষ নারায়ণ দেবনাথের জীবনাবসান হল আজ। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেড় হাজারেরও বেশি কমিকস স্ট্রিপ বানিয়েছেন তিনি। ‘হাঁদা-ভোঁদা’, ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে-ফন্টে’, ‘কৌশিক রায়’, ‘বাহাদুর বেড়াল’-এর মতো একের পর এক সিরিজের জন্ম দিয়েছেন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাঙালির শৈশব-কৈশোরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। বাঙালি কিশোরবেলার সঙ্গীদের রেখে চলে গেলেন তিনি। দীর্ঘ রোগভোগের পরে আজ থেমে গেল তাঁর কলম, পেন্সিল-তুলি। অনেকদিন ধরেই বয়সজনিত নানান সমস্যায় ভুগছিলেন। এর আগেও একাধিক বার মৃত্যুকে জয় করে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছিলেন, এবার আর শেষ রক্ষা হল না।

১৯২৫ সালে হাওড়ার শিবপুরে বাংলা কমিকের এই কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল। তাঁর পরিবারের আদি বাড়ি ছিল ওপার বাংলায়। তাঁদের পারিবারিক পেশা অলংকার নির্মাণ হওয়ায়, তাঁর বাড়িতে অলঙ্কার তৈরির চল ছিল। শিল্পের পরিবেশেই তাঁর বড় হওয়া, ছোটবেলায় তিনি নিজেও গহনার নকশায় হাত বুলিয়েছেন, যা এক সহজাত নান্দনিক শিল্পবোধ তৈরি করেছিল। স্কুলের পাঠ শেষ করে আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন নারায়ণ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে বন্ধ হয়ে যায় আর্ট কলেজে পড়া।

 

NarayanDebnatha1

 

সেই সময় চিত্রশিল্পীদের খুব একটা কাজের সুযোগ ছিল না। কয়েক বছর গয়না, শাড়ি, প্রসাধন দ্রব্য নির্মাতাদের জন্য বিজ্ঞাপনের ছোটোখাটো আঁকার কাজ করেছেন তিনি। গরানহাটা ও ধর্মতলার দুটি প্রতিষ্ঠানে হরফ শিল্পী হিসেবেও কিছুদিন কাজ করেছেন। তারপর কিছুদিন চলচ্চিত্রের টাইটেল কার্ড বানানোর কাজও করেছেন। জীবনতৃষ্ণা, স্বরলিপি, কমললতা প্রভৃতি চলচ্চিত্রে শিল্পী নারায়ণ দেবনাথের হাতের ছোঁয়া রয়েছে। কিন্তু এসব কাজ করে কী শিল্পীর শিল্পের ক্ষুদা নিবৃত্তি হয়! জাতশিল্পী, তাই নেশাকেই পেশা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

হঠাৎই দেব সাহিত্য কুটিরের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল। শুকতারা, অ্যাডভেঞ্চার বই, অনুবাদ বইয়ের প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ দিয়ে শুরু, সম্পূর্ণ নতুন এক চিত্রশিল্পের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় করালেন তিনি।

এরই মধ্যে দেব সাহিত্য কুটিরের থেকে ছবি দিয়ে গল্প তৈরির প্রস্তাব পেলেন, যা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। দেব সাহিত্য কুটিরের হাত ধরে বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে। সেই সময় বাংলা ভাষার কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ'র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা যুগান্তরে প্রকাশিত হত।

 

NarayanDebnatha2

 

১৯৬২ সাল, শুকতারা পত্রিকায় হাঁদা এবং ভোঁদাকে নিয়ে এলেন নারায়ণ বাবু। হাঁদারাম গড়গড়ি আর ভোঁদারাম পাকড়াশী নামের দুই দুষ্টু ছেলের কান্ডকারখানা। হাঁদা রোগা আর ভোঁদা মোটা। সবসময় একজন অন্যজনেকে, জব্দ করার ফন্দি আঁটে কিন্তু শেষে প্রায়ই হাঁদা জব্দ হয়। তাদের দুষ্টুমিতে প্রাঞ্জল হয়ে উঠল কমিক্সের পাতা। এই দুই চরিত্রকে আপন করে নেয় বাঙালি। হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠকদের মধ্যে সমাদৃত হতে শুরু হয়। 

হাঁদা ভোঁদা শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে তিনি নিজেই হাঁদা ভোঁদায় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৬৫ সাল থেকে তাঁর আরেক বিখ্যাত চরিত্র, বাংলা কমিকের একমাত্র অতিমানব বাঁটুল দি গ্রেট যাত্রা শুরু করে। নারায়ণ দেবনাথের প্রথম রঙিন কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেট

 

NarayanDebnatha3

 

নারায়ণবাবুর কথায়, কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেন এবং তৎক্ষণাৎ এঁকে ফেলেন। গোলাপী স্যান্ডো গেঞ্জি, কালো হাফ প্যান্ট, খালি পায়ে, বাঁটুল দি গ্রেট, তার সঙ্গীরাও বিচিত্র দুই ভাগ্নে ভজা, গজা, পটলা, লম্বকর্ণ, পোষা কুকুর ভেদো আর পোষা উটপাখি উটো। বাঁটুল সৎ ও দেশপ্রেমিক। সে ভারতের জন্য অলিম্পিক মেডেলও এনেছে। ষাটের দশকে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের পটভূমিতে মহাশক্তিধর বাঁটুলের কর্মযজ্ঞ তাকে বাঙালির কাছে হিরো বানিয়ে দেয়। কখনও সে শত্রুপক্ষের জাহাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে, কখনও যুদ্ধবিমানের সাথে লড়াই করে, আবার ট্যাঙ্কারও উড়িয়ে দেয়। বাঁটুল হয়ে গেল বাঙালির ঘরের সুপারহিরো। যদিও প্রথমটায় তিনি বাঁটুলকে কোন অলৌকিক শক্তি দেননি।

তাঁর তৈরি আরেক জনপ্রিয় কমিকস স্ট্রিপ সিরিজ হল নন্টে ফন্টে। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে কিশোর ভারতী পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয়সংখ্যায় নন্টে ফন্টে-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। হাঁদা এবং ভোঁদার আদলেই নন্টে এবং ফন্টেকে গড়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ।

 

NarayanDebnatha4

 

১৯৫০ সালে মনোরঞ্জন ঘোষের লেখা পরিবর্তন বইটির পুনর্মুদ্রণের সময়ে অলংকরণের ভার পড়ে নারায়ণ বাবুর উপর। ১৯৭২ সালে বইটির অলংকরণ করার সময়ে তিনি সেখানে কয়েকটি ছেলের হোস্টেল জীবনের গল্প পড়েন। তাঁর কমিক নন্টে ফন্টেতেও এরপরেই হোস্টেলের গল্প শুরু হয়। নন্টে ফন্টের বোডিং জীবনকে উপজীব্য করেই নারায়ণ বাবু তৈরি করতেন থাকেন একের পর এক সিরিজ। বাংলা কমিকের ইতিহাসে এত জনপ্রিয় আরেকটিও কমিক হয়েছে বলে মনে হয় না। খাদ্যরসিক সুপারিনটেনডেন্ট স্যার হাতিরাম পাতি, দুষ্টু ছাত্র কেল্টুরাম, রাঁধুনির মতো চরিত্ররা একে একে এসে পড়েন গল্পে, স্রষ্টা ও সৃষ্টি দুই অমর হয়ে যায়। 

নন্টে আর ফন্টে হরিহর আত্মা, স্কুলের সহপাঠী দুজনেই স্কুলের হোস্টেলে থাকে। কেল্টুরাম তাদের থেকে বয়সে বড়, হোস্টেলের ডেপো দাদা। অন্য ছাত্রদের মতো সে হাফ প্যান্ট পরে না, ফুল প্যান্ট পরে। হোস্টেল সিনিয়ররা যেমন হয়, সুপারিনটেনডেন্ট স্যারের সুনজরে থাকার চেষ্টা করে, অল্পবয়সী ছাত্রদের দিয়ে নিজের কাজকর্ম করিয়ে নেয়, কখনও ভয় দেখায়, কখনও বা অন্যভাবে কাজ হাসিলের পরিকল্পনা করে সব, সময় দাদাগিরি ফলায়। অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করলেও, নন্টে আর ফন্টের সাথে কেল্টু পেরে ওঠে না। অনেক ক্ষেত্রেই শেষটায় তার ভাগ্যে জোটে হাতিরামপাতির প্রহার। নন্টে-ফন্টের হোস্টেল যেন এক রূপকথা। এই হোস্টেল জীবন আর মিষ্টি কৈশোর

 

NarayanDebnatha5

 

বাঙালির জীবনে চিরকালীন হয়ে থাকবে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে নন্টে-ফন্টের কমিকস প্রথম বই হয়ে পাঠকের হাতে আসে। প্রযুক্তির দৌলতে টেলিভিশনে অ্যানিমেটেড বাংলা কার্টুন সিরিজ হিসেবে এসেছে নন্টে ফন্টে। পরবর্তীকালে কিশোর ভারতীর সম্পাদক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারায়নবাবুকে গোয়েন্দা গল্পের কমিক স্ট্রিপ করার প্রস্তাব দেন। তৈরি হয় ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায় চরিত্র। কিশোর ভারতীতে তাঁর আঁকা প্রথম ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হল 'ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ', যার একটি সংখ্যা বেরোয়। ২০১১ সালে লালমাটি প্রকাশন নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র ১ম ও ২ খন্ড রূপে তার কাজগুলি পুনরায় প্রকাশ করে। ২০১২ সালে বাঁটুল প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।

কেবল হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল আর নন্টে ফন্টেই নয়, পটলচাঁদ-দ্য ম্যাজিশিয়ান, শুঁটকি মুটকি, কৌশিক রায়, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়, বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, পেটুক মাস্টার বটুকলালের মতো অসাধারন মজার সব চরিত্র তাঁর সৃষ্টি।

 

NarayanDebnatha6

 

১৯৬২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটানা ৫৫ বছর তিনি নিয়মিত হাঁদা ভোঁদা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। যা একজন একক লেখক এবং শিল্পীর বিশ্বের সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা কমিক্স সিরিজ। আমাদের ছোটবেলা তাঁর হাতের জাদুস্পর্শে সম্পূর্ণতা পেয়েছিল, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির কাণ্ডকারখানা দেখে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলি বর্ণময় হয়ে উঠেছিল।চরিত্রগুলোর মধ্যে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা খুঁজে পাই।

ছবি দিয়েও যে গল্প বলা যায় তা তিনিই বুঝিয়েছিলেন আমাদের। প্রবাদপ্রতিম কার্টুনিস্ট হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন কিশোর সাহিত্যিকও বটে। ২০১৩ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র ভারতীয় কার্টুনিস্ট যিনি ডি.লিট অর্জন করেছেন। ২০২১ সালে তিনি পদ্মশ্রী, যা এই কদিন আগেই তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল। আজ থেকে তিনি দিকশূন্যপুরের লোক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...